পুস্তক পরিচয় ১...
কোনও স্থায়ী মীমাংসার সূচক নয়
গোর্খাল্যান্ড, ক্রাইসিস অব স্টেটহুড, রমিত বাগচী। সেজ, ৮৯৫.০০
মতা বন্দ্যোপাধ্যায় যত দিন মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের ক্ষমতায়, তত দিন গোর্খারা বাংলার সঙ্গে আছে— ২১ জুলাই ধর্মতলার মঞ্চ থেকে এ রকম একটা অঙ্গীকার শুনিয়ে গেলেন হরকাবাহাদুর ছেত্রী। যার অর্থ, পার্বত্য দার্জিলিঙের পৃথক রাজ্য হয়ে ওঠার আন্দোলন গোর্খা খণ্ডজাতীয়তার আত্মপরিচয়ের রাজনীতির তাগিদ দ্বারাই নির্ধারিত হবে, মহাকরণের অভিপ্রায় দ্বারা নয়। তবে মহাকরণের সহমর্মিতার উপরেও নির্ভর করছে সেই তাগিদের বাড়া-কমা।
পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য মানে আরও এক দফা বঙ্গ-ভঙ্গ, জেনে রাখা ভাল, এই শঙ্কার ঐতিহাসিক ভিত্তি বড় নড়বড়ে। কারণ, পার্বত্য দার্জিলিঙ বা ডুয়ার্সের উপর পশ্চিমবঙ্গের কোনও ইতিহাসসিদ্ধ দাবি নেই। পার্বত্য দার্জিলিঙ বরাবরই সিকিমের অংশ ছিল, নেপালের রানা ও ভুটানের রাজারা যার বিভিন্ন অংশ নানা সময়ে দখল করেন। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে নেপালের রানা সিকিমের চোগিয়াল তেনজিং নামগিয়ালের কাছ থেকে দার্জিলিঙ, কার্সিয়াঙ ও শিলিগুড়ি (তখন নাম ছিল পূর্ব মোরাঙ) ছিনিয়ে নেন। মাত্র বছর ত্রিশেক নেপালের অধীন থাকার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নেপালকে যুদ্ধে হারিয়ে ওই এলাকাগুলি পুনর্দখল করে সিকিমকে ফিরিয়ে দেয়। ১৮৩৫-এ সিকিম এলাকাগুলি কোম্পানিকে ‘উপহার’ দেয়। আবার ভুটানকে যুদ্ধে হারিয়ে কোম্পানি ১৮৬৫ সালে কালিম্পঙের দখল নেয়। অর্থাৎ বর্তমান দার্জিলিঙের কোনও অংশই প্রথাগত ভাবে বঙ্গদেশের সঙ্গে ছিল না। বঙ্গভঙ্গের গল্পটা তাই দাঁড়ায় না।
উল্টো দিক থেকে দেখলে নেপালিরাও কখনও দার্জিলিঙের ভূমিপুত্র নন। কোম্পানি যখন চোগিয়ালের কাছ থেকে দার্জিলিঙ যৌতুক পায়, তখন সেই অরণ্যশ্বাপদসংকুল পার্বত্য অঞ্চলে মেরে-কেটে শ’খানেক লেপচা’র বাস ছিল। কোম্পানি সাহেব প্রশাসকদের গ্রীষ্মকালীন অবসরযাপনের জন্য দার্জিলিঙকে তৈরি করা শুরু করতেই নেপাল থেকে গোর্খারা আসতে আরম্ভ করেন। চা-বাগান, রেলপথ, রাস্তা-ঘাট তৈরি এবং কৃষিজমি হাসিল করার পরিকাঠামোগত উদ্যোগে যুক্ত হতে হাজারে-হাজারে গোর্খা দরিদ্র নেপাল ছেড়ে অনুপ্রবেশ করতে থাকেন। লেপচা ও ভুটিয়া ভূমিপুত্ররা পিছু হটতে-হটতে ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যান। গোর্খা জনজাতির আত্মপরিচয়ের গল্পটা অতএব নির্ভেজাল নয়, ওতে জল মেশানো আছে। সেটা স্পষ্ট হয়ে যায় নেপালের প্রতি দার্জিলিঙের গোর্খাদের সাংস্কৃতিক আনুগত্যে। সুবাস ঘিসিং নেপালের প্রাক্তন রাজা বীরেন্দ্রকে লেখা চিঠিতে এই বিভক্ত আনুগত্যের সমস্যাটি উল্লেখ করেছিলেন। গোর্খাল্যান্ডের আগে যে গোর্খাস্তানের দাবি উঠেছিল, অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির তোলা সেই দাবিতে সমগ্র নেপালকেও গোর্খাস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব ছিল। নেপাল থেকে এখনও প্রতিদিন অনুপ্রবেশকারী গোর্খা পরিবারগুলি দার্জিলিঙ ও ডুয়ার্সের জনবিন্যাসের কাঠামো বদলে চলেছে। ১৯৫০-এর ভারত-নেপাল চুক্তির পরে যাদের অনুপ্রবেশ, তারাই অথচ পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবক। নেপালের রাজনীতিকরা অতীতে এই দাবির প্রতি সংহতি জানিয়েছেন। তবে গোর্খারা ভারতীয় নাগরিকত্বকে নেপালের নাগরিকত্বের চেয়ে বেশি দামি মনে করেছেন। পৃথক রাজ্যের দাবিটা ক্রমশ সংহত হয়েছে ভুটান, মেঘালয় ইত্যাদি জায়গা থেকে বিতাড়িত হয়ে শরণার্থী গোর্খা পরিবারগুলি ডুয়ার্সে ভিড় জমানোর পর। গোর্খারা ক্রমে লেপচা, ভুটিয়া ও অন্যান্য পাহাড়ি জনজাতিকে গ্রাস করে ফেলবে, এই আশঙ্কাই তাদের ভুটান ও মেঘালয় থেকে উৎখাত হওয়ার কারণ। গোর্খাল্যান্ড নামক কল্পরাষ্ট্রের ধারণায় এই তাড়া-খাওয়া শরণার্থীরা সান্ত্বনা ও আশা-ভরসা খুঁজে পেয়েছে।
বাঙালিদের অহমিকা, ঔদ্ধত্য, গোর্খাদের স্রেফ ‘দারোয়ান’ বা ‘চৌকিদার’ গণ্য করার আত্মম্ভরিতা পাহাড়ের জনজাতিকে ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ করেছে। গোটা পার্বত্য দার্জিলিঙ জুড়েই বাঙালি-বিরোধী বিদ্বেষ একটু-একটু করে সঞ্চিত হয়েছে। ডুয়ার্স ও তরাই অঞ্চলে কোচ-রাজবংশী জনজাতি, বাংলাভাষী পূর্ববঙ্গ-ফেরত মধ্যশ্রেণি, চা-বাগানে কর্মরত ছোটনাগপুর-সাঁওতাল পরগনার জনজাতিদের সঙ্গে গোর্খাদের দ্বন্দ্ব ও বিরোধের মূলে রয়েছে তীব্র পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং গোর্খাদের দ্বারা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা। গোর্খারা দার্জিলিঙে বন্ধ ডাকলে আদিবাসী বিকাশ পরিষদ ও বাংলা ভাষা বাঁচাও কমিটি ডুয়ার্সে পাল্টা বন্ধ পালন করেছে। পাহাড় ছেড়ে ডুয়ার্সে নেমে গোর্খারা প্রভাব বাড়াতে চাইলে প্রশাসন এবং বিকাশ পরিষদ উভয়েই বাধা দিচ্ছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পূর্বসূরির ঔদ্ধত্য ঝেড়ে ফেলে গোর্খা ভাইবোনদের কাছে টেনে নেওয়ার যে আন্তরিক ভঙ্গি নিয়েছেন, তাতে আপাতত বিমল গুরুঙ্গদের বিগলিত দেখাচ্ছে বটে। কিন্তু এটা কোনও স্থায়ী মীমাংসার সূচক নয়। গোর্খা আঞ্চলিক প্রশাসনের (জিটিএ) আওতায় ৩৯৬টি গোর্খা-অধ্যুষিত মৌজার অন্তর্ভুক্তির দাবি সরকার খারিজ করেছে। আবার জিটিএ-র নির্বাচনে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ছাড়া অন্য কোনও দলের প্রার্থী দেওয়া বিমল গুরুঙ্গ অনুমোদন করেননি। সমস্যার জটিলতাটা এ থেকেই স্পষ্ট। সুবাস ঘিসিং কিংবা বিমল গুরুঙ্গ যে ভাবে তাঁদের রাজনীতি চালনা করেন, তাতে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, প্রথা, ঐতিহ্যের প্রমাণ কমই মেলে। তাই গোর্খা জনজাতির আত্মশাসনের দাবি শেষ পর্যন্ত এই নায়কদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার দাবিতেই পর্যবসিত হবে, এমন আশঙ্কা প্রবল। আশঙ্কা হয়, তা কখনওই প্রতিনিধিত্বমূলক জনজাতীয় শাসনের চেহারা পাবে না। সুবাস ঘিসিং কিংবা বিমল গুরুঙ্গ কিংবা ভবিষ্যতে হয়তো আরও জঙ্গিতর কোনও নেতার ইচ্ছায় গোর্খারা চালিত হবেন। তাঁদের তুষ্ট করে চলার ওপর নির্ভর করবে মহাকরণের ‘পাহাড় সমস্যা সমাধান’-এর সাফল্য।
রমিত বাগচী সাংবাদিক। ২০০৭ থেকে শিলিগুড়িতে। দেখেছেন আন্দোলনের নানা মুখ, মুখোশও। নেতাদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সঙ্গেও মিশেছেন ঘনিষ্ঠ ভাবে। গোর্খাল্যান্ড বিষয়ে তাঁর গবেষণার পরিধিও ব্যাপক। পাঠকদের একটা প্রাসঙ্গিক বই উপহার দিয়েছেন তিনি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.