ব্রেকফাস্টের টেবিল হোক বা হোটেলের ছ’তলার করিডর, কান পাতলেই ফিসফিসানি উল্টো দিকের ভারত মহাসাগরের ঢেউয়ের মতোই ধেয়ে আসছে।
কেউ কাঁধ ঝাঁকাচ্ছেন, কেউ চোখ টিপে বলছেন, “সবই তো দেখছেন, এটা জবরদস্তি ছাড়া কী?” কিন্তু পরের লাইনটাই আসল‘এ সব লিখবেন না কিন্তু!’ দেখবেন, শুনবেন, জানবেন, কিন্তু লেখা যাবে না! লন্ডন অলিম্পিকের গনগনে আবহে শ্রীলঙ্কায় একটা পাঁচ ম্যাচের ওয়ান ডে সিরিজকে আকর্ষণের দাঁড়িপাল্লায় এলেবেলে মনে হতে পারে, কিন্তু কলম্বোয় পা রেখে টিমের কাণ্ডকারখানা দেখে কেউ যদি আলেকজান্ডারের মতো ‘সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই টিম ম্যানেজমেন্ট!’ দিয়ে প্রতিবেদন শুরু করে, তাকে দোষ দেওয়া কঠিন।
হেঁয়ালি থাক। এক কথায় প্রসঙ্গ রোহিত শর্মা বনাম মনোজ তিওয়ারি। দুটো ম্যাচ হয়ে গিয়েছে, সিরিজ ১-১, কাল প্রেমদাসায় তিন নম্বর ম্যাচটায় প্রথম এগারোয় কে? ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থেকে হাম্বানটোটায় দ্বিতীয় ম্যাচটার পরে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি বলেছিলেন, “খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত। দেখা যাক, কলম্বো পৌঁছে দেখছি।” আর কলম্বো পৌঁছে কী হল? নিজে না এসে ম্যাচের আগের দিন কেকেআর অধিনায়ক গৌতম গম্ভীরকে দুপুর-দুপুর টিম হোটেলে প্রচারমাধ্যমের সামনে পাঠিয়ে দিলেন ধোনি। হাতে গোনা উপস্থিতি ভারতীয় প্রচারমাধ্যমের, কিন্তু সেখানেও ঘুরেফিরে প্রশ্নটা তো একই। কত দিন রোহিতকে টানা হবে বা কত দিন মনোজ বসে থাকবেন? “ম্যাচে যাই হোক, নেটে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল ব্যাট করছে রোহিত। ২০১৫ বিশ্বকাপের ভাবনায় ও আছে। এখনই বাদ দিলে ওর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরতে পারে। তা ছাড়া কোনও একজন ব্যক্তি নিয়ে আমি কথা বলতে পছন্দ করি না। কিন্তু এটা বলতে পারি, মনোজের জন্যও সুযোগ আসবে,” গম্ভীর কথা শেষ করতে না করতে প্রশ্ন উড়ে এল, “কিন্তু কবে?”
এ বার উত্তর, “এই সিরিজে। কিংবা হয়তো তার পরের সিরিজে। কেউ জানে না।”
সত্যিই, কিছু প্রশ্নের উত্তর ভারতীয় ক্রিকেটে কেউ জানে না, বরাবর অজানা থেকে যায়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এক ক্রিকেটার মাঠের বাইরে বসে থাকছেন আর অন্য একজন টানা সুযোগ পেয়েই চলেছেন। প্রথম জন মনোজ, শেষ ওয়ান ডে খেলেছেন গত বছরে ডিসেম্বরে, চেন্নাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি। তার পরে টানা ১৩ ম্যাচ বসে আছেন। অস্ট্রেলিয়া সফরে আটটা ম্যাচ, এশিয়া কাপে তিনটে, এই সিরিজে দুটো। পাশাপাশি ২০১২-তে টানা ন’টা ম্যাচে সুযোগ পেয়েও রোহিত শর্মার ব্যাটিং গড় ১৭.৩৩। শেষ ন’টা ইনিংসে রান ২১, ১০, ৩৩, ১৫, ০, ৪, ৬৮, ৫ ও ০। ধোনির ‘স্নেহধন্য’ রায়নাও যে একের পর এক ম্যাচ জিতিয়ে যাচ্ছেন, তা-ও নয়। তবু প্রথম এগারোয় কিছুতেই মনোজের জায়গা হচ্ছে না। ২০০৮-এর শুরুর দিকে আট মাসের ব্যবধানে মনোজ আর রোহিতের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল। এত দিনে রোহিত জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ৮২টি ম্যাচ, মনোজ ছ’টি!
টিমের কেউ কিছু যখন বলবেই না, ধরা গেল এখানে থাকা একমাত্র জাতীয় নির্বাচক নরেন্দ্র হিরওয়ানিকে। উত্তরটা এ রকম, “দেখুন, এটা আপনি ধোনিকে জিজ্ঞেস করুন। আমরা পনেরো জনকে বেছে পাঠিয়েছি। কিন্তু প্রথম এগারো কী হবে না হবে, সেটা পুরোপুরি টিম ম্যানেজমেন্টের ব্যাপার।” জাতীয় দলের বিদেশ সফরে নির্বাচকদের পাঠানোটা এখন রীতি। কিন্তু ব্যাপারটা পুরোপরি সবেতন ছুটির পর্যায়ে। শ্রীলঙ্কা সফর মানে টিম হোটেলে থেকে উল্টো দিকে ভারত মহাসাগরের ঢেউ গোনা ছাড়া জাতীয় নির্বাচকের কোনও কাজ নেই।
রাহুল শর্মা নিষিদ্ধ মাদক নিয়ে মুম্বই পুলিশ কর্তৃক অভিযুক্ত হলে কী হবে, বহাল তবিয়তে টিমের সঙ্গে ঘুরছেন। বিতর্কিত, তাই ম্যাচ খেলার প্রশ্ন নেই। দেশেও ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি, ম্যাচও খেলানো হচ্ছে না। খাচ্ছেন-দাচ্ছেন, ঘুরছেন। আর বেচারি মনোজ? দুপুরে বলছিলেন, “আমি কোনও কিছু নিয়েই ভাবতে চাই না। পেশাদার হিসেবে যে কোনও পরিস্থিতির জন্য আমি তৈরি।”
মনোজ কিছু না বলতে পারেন, কিন্তু আমরা পারি‘কী বিচিত্র এই টিম ম্যানেজমেন্ট!’ |