এক দিকে জমির অধিকারের লড়াই। অন্য দিকে নানা জনগোষ্ঠীর পরস্পরের স্বার্থবিরোধী দাবি। অসমের চিরাচরিত এই সমস্যাই নামনি অসমে ফের সংঘর্ষের পিছনে মূল কারণ বলে মনে করছে কেন্দ্র। তাই বিবদমান দুই গোষ্ঠীর নেতাদের বিরুদ্ধেই দ্রুত কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দু’পক্ষের উপরেই চাপ তৈরি করে হিংসা ঠেকানোই এখন সরকারের রণকৌশল। এই কৌশলে সংঘর্ষ আপাতত সামাল দেওয়া গেলেও বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে যে, এতে কি সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হবে?
অসমের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, এই সংঘর্ষের পিছনে রয়েছে নামনি অসমের বড়ো জনগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে অ-বড়োদের জমির অধিকারের লড়াই। তার সঙ্গেই ব্রহ্মপুত্র নদীর উত্তর তিরের গোটা এলাকা নিয়ে নতুন করে পৃথক বড়োল্যান্ড রাজ্যের দাবি ওঠায় উত্তেজনা তৈরি হয়। কারণ সেখানকার সংখ্যালঘু ছাত্র সংগঠনগুলি এই নিয়ে আপত্তি জানায়। এর ফলে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ত তিক্ত হতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই প্রথমে দু’জন সংখ্যালঘু যুবক খুন হওয়া, তার পরে চার বড়ো যুবকের খুনের ঘটনা আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পদস্থ আমলা থেকে শুরু করে গবেষক সকলেরই মত, প্রশাসনের তরফে হিংসা বন্ধ করে পরিস্থিতি শান্ত করাটা নেহাতই স্বল্পমেয়াদি সমাধান। এমন ভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে, যাতে তা সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়। শুধু সরকারি হস্তক্ষেপে হবে না, বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের নেতাদেরও বড় ভূমিকা নিতে হবে। তাঁদের বক্তব্য, সহাবস্থান ও অন্যদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস তৈরি করাটাই এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের চাবিকাঠি।
প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব জি কে পিল্লাই বলছেন, “জমির অধিকারের সমস্যাটা অন্যতম সমস্যা।” বড়ো-রা অসমের বৃহত্তম আদিবাসী জনগোষ্ঠী। নিজেদের এলাকায় জমির উপরে অধিকার সুনিশ্চিত করতেই জঙ্গি আন্দোলন শুরু করেছিল তারা। ২০০৩ সালে দ্বিতীয় বড়ো-চুক্তির পরে বড়োল্যান্ড আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়। কিন্তু সেখানেই সমস্যার মূল উৎস লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ যে চারটি জেলা নিয়ে স্বশাসিত পরিষদ হঠন হয়েছে, সেখানে বড়ো-রা সংখ্যালঘু। পিল্লাইয়ের কথায়, “স্বশাসিত পরিষদে বড়ো-রাই বিশেষ সুবিধা, রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করে। তবে ওঁরা সকলকে নিয়েই চলার চেষ্টা করেন। কারণ ওঁরা জানেন যে, ওঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নন। মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪০% বড়ো জনগোষ্ঠীভুক্ত। বড়ো-রা ছাড়া ওখানে বাঙালি, নেপালি, সাঁওতাল, ছোট ছোট আদিবাসী গোষ্ঠীও রয়েছে।”
কিন্তু এখন বড়ো নেতারা অভিযোগ তুলেছেন, ‘বাইরের লোক’ তাদের এলাকায় ঢুকে জমির দখল নিচ্ছে। ‘বাইরের লোক’ বলতে শুধু অ-বড়ো সম্প্রদায় নয়, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের দিকেও অভিযোগের আঙুল উঠেছে। উল্টো দিকে অন্য জনগোষ্ঠীর নেতাদের অভিযোগ, তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও জমির অধিকার এবং সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের ফলে অনেকে গৃহহারা হয়ে পড়েছেন। তাই তাদের নতুন আশ্রয় খুঁজতে হচ্ছে। তখনই তাদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী তকমা দেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে এ বার এনডিএফবি-র মতো বড়ো জঙ্গি-সংগঠন নতুন করে পৃথক বড়োল্যান্ড রাজ্যের দাবি তোলায় তাঁরা আতঙ্কিত।
সেন্টার ফর নর্থ-ইস্ট স্টাডিজ অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ-এর প্রধান সঞ্জয় হাজরিকার যুক্তি, “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে যাঁদের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে, তাঁরা অনেক দিন ধরেই ওখানে বসবাস করছেন। তাঁদের এখন অনুপ্রবেশকারী বলে দেওয়াটা আসলে বিষয়টাকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা।” তাঁর মতে, এই ধরনের ঘটনা হঠাৎ হয়নি। অনেক কারণ আছে। পিল্লাই যেমন বলছেন, জমির অধিকার নিয়ে অতীতেও বড়োদের সঙ্গে কখনও বাঙালিদের, কখনও নেপালিদের সংঘর্ষ হয়েছে। ২০০৮ সালে উদালগুড়িতে একই ধরনের সংঘর্ষে একশো জনেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
কিন্তু এত কিছুর পরেও কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার কোনও শিক্ষা নেয়নি কেন? হাজরিকার যুক্তি, “সরকার বা প্রশাসনের তরফে চেষ্টা হয় পরিস্থিতি শান্ত করার। কিন্তু সেটা স্বল্পমেয়াদি সমাধান।” এর পিছনে অনেক রকম প্ররোচনা থাকতে পারে বলেও তিনি মনে করছেন। জনগোষ্ঠী বা ধর্মের নিরিখে মেরুকরণ হলে তাতে রাজনীতির কারবারিদেরই সুবিধা। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে তাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে। কারণ নিরবচ্ছিন্ন অনুপ্রবেশ হতে থাকলে, শুধু কৃষি বা বসবাসের জমি নয়, রোজগারের সুযোগও সঙ্কুচিত হতে বাধ্য। রাজ্য সরকারের তরফে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, যাঁরা আগে থেকেই রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে যাঁরা সদ্য সীমান্ত পেরিয়ে এসেছেন, তাঁদের আলাদা করা মুশকিল। তবে বিশেষজ্ঞদের মত, রাজ্য সরকারের এই বক্তব্য নেহাতই অজুহাত। তাঁদের বক্তব্য, সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক হারানোর ভয়ে কেউই এ বিষয়ে কঠোর হয় না।
স্বল্পমেয়াদি সমাধান হিসেবে স্বরাষ্ট্রসচিব রাজকুমার সিংহ বলছেন, হিংসা বন্ধ করার জন্য দুই সম্প্রদায়ের নেতাদের উপরেই চাপ তৈরি করতে হবে। আর হাজরিকা-পিল্লাইরা বলছেন, সকলের সঙ্গে বারেবারে আলোচনায় বসে সহাবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা চালাতে হবে সরকারকে। না হলে সমাধান দূর অস্ত্। |