কিছুটা দেরিতে হলেও জেলায় মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে বা হয়েছে। শুরু হয়েছে চাষ। কিন্তু হঠাৎ বীজতলায় ধসা ও ঝলসা রোগ দেখা দেওয়ায় দিন কয়েকের মধ্যে দুবরাজপুরের পারুলিয়া পঞ্চায়েত অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার প্রচুর বীজতলা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। চাষিদের প্রশ্ন এখন ধানের চারা না পেলে আমন চাষ করবেন কী ভাবে?
ওই পঞ্চায়েত এলাকার বহু চাষি তাঁদের সমস্যার কথা লিখিত ভাবে দুবরাজপুরের বিডিও এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিকারিককে জানিয়েছেন। তবে সমস্যা মেটার বদলে দিন দিন তা ঘোরালো হচ্ছে বলে দাবি চাষিদের। তাঁদের ক্ষোভ, কিছু একটা করুক প্রশাসন। না হলে চাষই করতে পারবেন না এলাকার প্রায় ৬০ শতাংশ চাষি। দুবরাজপুরের বিডিও গোবিন্দ দত্ত বলেন, “সমস্যাটা শুধু ওই অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ব্লকের বিভিন্ন জায়গা থেকেই বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়ার খবর এসেছে। খবর পাওয়া মাত্রই জেলায় জানানো হয়েছে। আক্রান্ত বীজতলাগুলিকে বাঁচাতে বা আগামীদিনে কৃষকদের কী করতে হবে সেটা তাঁদের জানানো হবে।” ব্লক কৃষি সম্প্রসারণ অধিকারিক গোঁসাইদাস বিশ্বাস জানান, কী ভাবে এই রোগ কমানো যায় সেই বিষয়ে চাষিদেরকে সচেতন করতে ইতিমধ্যেই পঞ্চায়েত এলাকায় লিফলেট বিলি করা শুরু হয়েছে। |
পারুলিয়া পঞ্চায়েতে এলাকার করমকাল গ্রামের চাষি মুক্তি পাল, রাজগঞ্জ গ্রামের সঞ্জয় মণ্ডল, রাওতারা গ্রামের দেবাশিস মণ্ডল বা হাজরাপুর গ্রামের মহম্মদ মুসারা বলেন, “চাষের জমি তৈরি ও ধান পুঁতলেই হল। কিন্তু জৈষ্ঠ্য মাসে জমি তৈরি করে বীজ ফেলে যে বীজতলাগুলি তৈরি করেছিলাম ধান পোঁতার আগেই হঠাৎ তাতে ধ্বসা রোগ দেখা দেয়। মূলত ‘স্বর্ণ’ ধানের বীজতলাগুলিতে এই রোগ ছড়িয়েছে। পাতাগুলি প্রথমে হাল্কা বাদামী হচ্ছে পরে শুকিয়ে যাচ্ছে। ইউরিয়া (নাইট্রোজেন) বা চাপান সার দেওয়ার পরেই রোগের প্রকোপ আরও বেড়ে যাচ্ছে। কীটনাশক ব্যবহার করেও ফল মেলেনি। যে বীজতলায় সবে মাত্র রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে সেই বীজতলার ভাল চারা লাগালেও বাঁচছে না।”
এই অবস্থায় কেউ কেউ লাঙল টেনে নতুন বীজতলাও তৈরি করছেন। তবে নতুন বীজতলা থেকে চারা তুলে এ বছর আমন ধান চাষ করা সম্ভব কি না বা যে সব বীজতলা নষ্ট হয়ে গিয়েছে সেই ঘাটতি কী ভাবে মিটবে তা নিয়ে সংশয়ে সকলে।
কৃষিদফতর এই রোগকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করেছে, যথা ঝলসা, ব্যাকটিরিয়া ধ্বসা এবং খোলা ধ্বসা। এই রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে কৃষকদের অসাবধানতাকেই দায়ী করেছে কৃষিদফতর। দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “যে প্রজাতির ধানের বীজতলাগুলিতে এই রোগ দেখা দিয়েছে সেটি উচ্চ ফলনশীল। নিয়ম অনুযায়ী লাগাবার আগে এ ধরনের ধান চাষের বীজ ঠিক মতো শোধন করে নিতে হয়। সব ক্ষেত্রে চাষিরা সেটা করেন না। দ্বিতীয়ত--নিজেদের বাড়িতে বছরের পর বছর বীজ রেখে চাষ করার ফলেও এই রোগ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিন বছর অন্তর বাড়িতে রাখা বীজের পরিবর্তে সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা থেকে ধানের বীজ সংগ্রহ করা এবং জমিতে যে পরিমাণ পটাশ সার ব্যবহার করার কথা সেটাও না করাতেই এই বিপত্তি।” এই অবস্থায় লিফলেটে নির্দেশিত ওষুধ প্রয়োগ করলে এখনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলে জানিয়েছেন ওই আধিকারিক।
জেলা কৃষি দফতরের উপকৃষি আধিকর্তা অমর মণ্ডল বলেন, “শুধু দুবরাজপুরেই নয় খয়রাশোল এবং সাঁইথিয়া-সহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় বীজতলায় ধ্বসা রোগ হয়েছে বলে শুনেছি। তবে সেগুলি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে খবর নেই। চাষিরা সাধারনত উদ্বৃত্ত চারা তৈরি করে থাকেন সেটা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেলে ভাল নতুবা বিকল্প চাষের জন্য চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হবে।”
তবে এখনও পর্যন্ত জেলায় বৃষ্টিপাতের যা ঘাটতি সেটা না মিটলে জেলায় ৫০ শতাংশ জমিতে চাষ মার খাবে বলে আশঙ্কা করছেন অমরবাবু। তিনি বলেন, “জেলায় এ বার আমন ধান চাষের লক্ষ্য মাত্রা রাখা হয়েছিল ৩ লক্ষ ১২ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে। এ পর্যন্ত মাত্র ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে ধান লাগানো সম্ভব হয়েছে।”
জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হওয়ায় চাষ মার খাচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা-সহ কৃষি অধিকর্তা অরিন্দম চক্রবর্তীও। জোলা কৃষি বিভাগের কর্তাদের আশঙ্কার রেষ কৃষকদের মধ্যেও। ময়ূরেশ্বরের নবগ্রামের বংশী মণ্ডল এবং লাভপুরের ভুবনডাঙার বিবেকানন্দ মণ্ডলরা বলেন, “অন্য বার সিংহভাগ জমিতে চাষ হয়ে যায়। এ বারে সেখানে সামান্য জমিতেই চাষ করেছি। তবে শুধুমাত্র কম বৃষ্টিপাতই একমাত্র কারণ নয়। সঙ্গে রয়েছে মজুরের সমস্যা, বিদ্যুত ঘাটতি। ফলে সাবমার্সিবল চালাতে না পারা।” রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকেও দায়ী করছেন বিবেকানন্দ বাবুরা। |