সম্পাদকীয় ১...
তবুও যুক্তি
প্রবীণ রাজনীতিক প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতের রাষ্ট্রপতি হইয়াছেন। ‘প্রবীণ’ শব্দটি বাংলায় প্রাচীন বা বয়স্ক অর্থেই প্রচলিত। তবে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুসারে শব্দটির মূল অর্থ: বীণাবাদনে প্রকৃষ্ট। সেই মূল হইতে প্রসার ঘটাইয়া সাধারণ অর্থ নির্দিষ্ট হইয়াছে: নিপুণ, অভিজ্ঞ, কুশল, পণ্ডিত। কিন্তু মূল অর্থটি বিলুপ্ত হয় নাই, তাহার মর্ম প্রসারিত অর্থেও নিহিত থাকিয়াছে। একটি কাজে বা বিদ্যায় প্রকৃষ্টতা অর্জন করিয়াই প্রকৃত অর্থে প্রবীণ হওয়া যায়। বয়স সেই অর্জনের ক্ষেত্রে নিতান্ত গৌণ ব্যাপার। প্রণব মুখোপাধ্যায় এই নিহিতার্থেও প্রবীণ। তিনি রাজনীতিতে প্রকৃষ্টতা অর্জন করিয়াছেন। কোনও বৃহৎ অর্থে রাজনীতি নয়, ফলিত তথা বাস্তব রাজনীতি। প্রণব মুখোপাধ্যায় নিপুণ ভাবে তাহার চর্চা করিয়াছেন। তাঁহাকে যখন যে কাজ করিতে দেওয়া হইয়াছে, তিনি তখন তাহা দক্ষ ভাবে সম্পন্ন করিয়াছেন। ইউ পি এ জমানার দ্বিতীয় পর্বে বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠীর সমন্বয় সাধন করিয়া রাজনৈতিক ‘ব্যবস্থাপনা’র যে কাজ তিনি সাধন করিয়া গিয়াছেন, তাহা এই প্রবীণতার পরিচায়ক। এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশ্ন: এক জন রাজনীতিক কি রাষ্ট্রপতি পদের উপযুক্ত? ইহা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের যোগ্যতার প্রশ্ন নহে, ইহা নীতিগত প্রশ্ন। রাষ্ট্রপতি পদটি রাজনীতির ঊর্ধ্বে বলিয়াই সেই পদের জন্য রাজনীতির বাহিরের জগতের বিশিষ্ট জনকে আহ্বান জানানো বিধেয়। তাহা ঘটে নাই। যে রাষ্ট্রপতি বিদায় লইলেন, তিনিও রাজনীতির মানুষ, যিনি আসিলেন তিনিও।
এখন ভরসা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রবীণতা। যে নিপুণতার সহিত তিনি তাঁহার রাজনীতিক জীবনের দায়িত্ব নির্বাহ করিয়াছেন, সেই নিপুণতার সহিতই তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নির্বাহ করিবেন, ইহাই তাঁহার নিকট ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রত্যাশা। প্রত্যাশা ইহাই যে, রাজনীতির অভিজ্ঞতা তাঁহাকে রাজনীতিকে অতিক্রম করিবার দক্ষতাও দান করিয়াছে। ভারতীয় রাষ্ট্রপতির প্রথম ও প্রধান কর্তব্য: নিজেকে নিষ্ক্রিয় করিয়া রাখা। নিষ্ক্রিয়তাই তাঁহার সাফল্য তথা সার্থকতার ধর্ম। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান, কিন্তু আনুষ্ঠানিক প্রধান মাত্র। প্রশাসনের দায়িত্ব ও অধিকার মন্ত্রিসভার, যে মন্ত্রিসভা আইনসভার নিকট দায়বদ্ধ। সেই প্রশাসনের আদেশগুলি রাষ্ট্রপতির নামে দেওয়া হইবে, ইহাই ভারতীয় গণতন্ত্রের অনুশাসন। এ ক্ষেত্রে তাঁহার কোনও মত নাই, থাকিতে পারে না। অতীতে যে রাষ্ট্রপতি যখনই এই সীমা অতিক্রম করিয়া সক্রিয় হইয়াছেন, গণতন্ত্রের অমর্যাদা ঘটিয়াছে, বিপদও। আশা করা যায়, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় নিষ্ক্রিয়তার নূতন আদর্শ সৃষ্টি করিবেন।
এবং এই সূত্রেই গভীরতম প্রশ্নটিও অনিবার্য। রাষ্ট্রপতি পদটি ভারতীয় গণতন্ত্রে কেন প্রয়োজনীয়? যে পদটির ভূমিকা, আক্ষরিক অর্থেই, নামমাত্র, যে পদের অধিকারীর কোনও প্রকৃত ক্ষমতাই নাই, থাকিতে পারে না, সেই পদ কেন আদৌ থাকিবে? প্রচলিত এবং পরিচিত উত্তর: সরকার এবং রাষ্ট্র এক নয়, রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে একটি স্বতন্ত্র পদ থাকা জরুরি। ইহা উত্তর নয়, উত্তরের ভানমাত্র। রাষ্ট্র এবং সরকারের কেন স্বতন্ত্র নায়ক থাকিতে হইবে? এ দেশের শাসনতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীই সরকারের প্রধান। তিনিই কেন রাষ্ট্রের প্রধান হইবেন না? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট উভয়েরই প্রধান, তাহাতে কোন সংবিধান অশুদ্ধ হইয়াছে? ভারতে রাষ্ট্রপতির আনুষ্ঠানিক পদটি ইংল্যান্ডের শাসনতন্ত্রের উত্তরাধিকার। ইংল্যান্ডের ইতিহাস তাহার বিশেষ ঘটনাপরম্পরা হইতে রাজা বা রানির ভূমিকা নির্দিষ্ট করিয়াছে, ইংল্যান্ডের সমাজ সেই ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়াছে, উহা সেই দেশের নিজস্ব ব্যাপার। ভারত কেন তাহার উত্তরাধিকার বহন করিয়া চলিবে? রাষ্ট্রপতি ভবনে বাঙালির এই প্রথম প্রতিষ্ঠা। ইহা আনন্দের কারণ, গৌরবের উপলক্ষ, আবেগের মুহূর্ত। কিন্তু আবেগ যুক্তির ঊর্ধ্বে উঠিতে পারে না। স্বভাবত যুক্তিনিষ্ঠ প্রণব মুখোপাধ্যায় নিশ্চয়ই তাহা মানিবেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.