|
|
|
|
বীরসিংহ গার্লসের শুভ্রাদি আজ দেশের ‘ফার্স্ট লেডি’ |
অভিজিৎ চক্রবর্তী • ঘাটাল |
নামেই মেয়েদের স্কুল। কোনও নিজস্ব ভবন নেই। স্থানীয় হাইস্কুল বা লাইব্রেরির ঘরে গাদাগাদি করে বসে ছাত্রীরা। শিক্ষিকারা কোনও রকমে পড়ান। তারই মধ্যে ছাত্রীদের একটু অন্যরকম স্বাদ দিতে চাইতেন এক শিক্ষিকা। পড়াশোনার বাইরে জোর দিতেন গানে। খোলা গলায় গাইতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, যত্নে শেখাতেনও।
সে দিনের সেই দিদিমণি, ছাত্রীদের অতি প্রিয় শুভ্রাদি-ই আজ দেশের ‘ফার্স্ট লেডি’। সদ্য নির্বাচিত প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। |
|
বীরসিংহ বালিকা বিদ্যাপীঠ। |
সালটা ১৯৭১। সবে পথ চলা শুরু করেছে ঘাটালের বীরসিংহ বালিকা বিদ্যাপীঠ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গ্রামে মেয়েদের স্কুল। নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতির উদ্যোগেই এই স্কুলের জন্ম। জন্মলগ্নেই ইতিহাসের শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। স্কুলের রেকর্ড বলছে ৮.২.১৯৭১ থেকে ১৭.৮.১৯৭১, সাকুল্যে ছ’মাসের কিছু বেশি সময় এখানে পড়িয়েছেন শুভ্রাদেবী। তবে সকলকে আপন করে নেওয়ার গুণে জনপ্রিয় হয়েছিলেন সহজেই।
প্রণববাবু তখন সবে সাংসদ হয়েছেন। মেয়ে শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে বীরসিংহ গ্রামেই থাকতেন শুভ্রাদেবী। মাঝেমধ্যে প্রণববাবুও আসতেন। সেই সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন রমা চক্রবর্তী (চট্টোপাধ্যায়)। বালি, উত্তরপাড়ায় বাড়ি হলেও অবসর নেওয়ার পর জলপাইগুড়িতে ছেলের কাছে থাকেন তিনি। ফোনে রমাদেবী জানালেন, যৎসামান্য বেতনেই পড়াতেন তাঁরা। কিন্তু পড়ানোর প্রতি একটা টান ছিল। রমাদেবীর কথায়, “শুভ্রা আমার থেকে বয়সে বড়। তা-ও দিদি বলেই ডাকত। আমি বারণ করলে বলত, ‘তুমি যে স্কুলের সবার বড়দি’। ও মেয়ে শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে আমার সঙ্গেই স্থানীয় কৃষ্ণপদ ঘোষের বাড়িতে থাকত। শর্মিষ্ঠাকে তো মুন্নি বলেই চিনি আমরা।” প্রণববাবুকেও কাছ থেকে দেখেছেন রমাদেবী। তাঁর কথায়, “শনি-রবি করে প্রণববাবু আসতেন। মাটির দো’তলা বাড়িতে চাটাই পেতে শুতে দেখেছি ওঁকে। আজ সেই মানুষটাই দেশের রাষ্ট্রপতি। ভাবতেই কেমন লাগছে।” |
|
স্মৃতিচারণায় গ্রামের প্রবীণেরা। |
বীরসিংহ হাইস্কুলের করণিক ছিলেন কৃষ্ণপদ ঘোষ। প্রথম মাস দুয়েক মেয়েকে নিয়ে কৃষ্ণপদবাবুর বাড়িতেই ভাড়া ছিলেন শুভ্রাদেবী। কৃষ্ণপদবাবু এখন আশি ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধ। স্মৃতি হাতড়ে জানালেন, “প্রণববাবুকে দেখেছি তো। পিঠে খেতে খুউব ভালবাসতেন।” বীরসিংহ গ্রামে বেশিরভাগ সময়টাই শুভ্রাদেবী ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা রাধানাথ চক্রবর্তীর বাড়িতে। রাধানাথবাবু দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে চাকরি করতেন। তাঁর স্ত্রী রেখাদেবী বলেন, “প্রথম কটা দিন শুভ্রা নিজেই রেঁধে খেয়েছিল। পরে একেবারে বাড়ির লোক হয়ে গেল। আমিই রান্না করতাম। প্রণবদাকেও রেঁধে খাইয়েছি মুসুর ডাল, কুমড়োর ছক্কা আর পোস্তোর বড়া।” সে দিনের প্রণবদা-ই আজ দেশের রাষ্ট্রপতি! কেমন লাগছে? রেখাদেবীর জবাব, “তখনও তো সাংসদ ছিলেন। ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে ওঠাবসা। হাবেভাবে অবশ্য সে সব বোঝা যেত না। একেবারে সাধারণ। শুভ্রারও কোনও গুমর ছিল না। আমার ননদের সঙ্গে গিয়ে কলমি শাক পর্যন্ত তুলেছে।”
|
শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। |
রাধানাথবাবু জানালেন, প্রণববাবু এলে গ্রাম বেড়াতে বেরোতেন। স্থানীয় পঙ্কজ মুখোপাধ্যায়, কমলাকান্ত ঘোষদের সঙ্গে আড্ডা মারতেন। পঙ্কজবাবু ও কমলাকান্তবাবু মারা গিয়েছেন। তবে সেই স্মৃতিচারণা করলেন কমলাকান্তবাবুর ছেলে প্রাক্তন শিক্ষক প্রণব ঘোষ আর পঙ্কজবাবুর ভাইপো বীরসিংহ লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান অরুণ মুখোপাধ্যায়। অরুণববাু বলেন, “আমার তখন বছর সতেরো বয়স। মনে আছে প্রণব মুখোপাধ্যায় আমাকে চারমিনার সিগারেট আনতে বলেছিলেন।”
স্থানীয় ব্যবসায়ী তরুণকান্তি ঘোষের স্ত্রী স্মৃতিকণাদেবী ছিলেন শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের ছাত্রী। বললেন, “ইতিহাস ছাড়াও বাংলা ব্যকরণ পড়াতেন শুভ্রাদি। তবে সব থেকে ভাল লাগত ওঁর গান। আমাদের তো বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত সেখাতেন। উনিই জাতীয় সঙ্গীতের বাইরে বেশ কিছু গান প্রার্থনা সঙ্গীতের তালিকায় ঢুকিয়েছিলেন।” প্রণব-পত্নীর আরও এক ছাত্রী রমা সিংহ এখন ঝাঁকরা হাইস্কুলের ভুগোলের শিক্ষিকা। তাঁর কথায়, “শুভ্রাদির প্রেরণাতেই আজ আমি শিক্ষিকা হয়েছি।”
বীরসিংহ বালিকা বিদ্যাপীঠের বর্তমান শিক্ষিকাদের কেউ-ই শুভ্রা মুখোপাধ্যায়কে দেখেননি। তবে সব জেনে-শুনে তাঁরা গর্বিত। স্কুলের এখন পাকা বাড়ি হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত শিক্ষিকা নেই। রয়েছে পরিকাঠামোগত সমস্যাও। প্রধান শিক্ষিকা মীরা রায় বলেন, “উনি আজ রাষ্ট্রপতির স্ত্রী। নিজে এককালে যেখানে পড়িয়েছেন, সেই স্কুলের উন্নয়নে সাহায্যের বন্দোবস্ত করলে আমরা খুব খুশি হব। আর চাই প্রণববাবু সস্ত্রীক আমাদের এখানে আসুন।”
|
—নিজস্ব চিত্র। |
|
|
|
|
|