প্রবন্ধ ২...
বিমল লামা চমৎকার বাংলা উপন্যাস লিখেছেন
মার আকৈশোর বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘এ রাজ্যের পাহাড়ে বাংলা ভাষা থাকবে না?’ লেখাটি (২ শ্রাবণ ১৪১৯, ১৮ জুলাই ২০১২) আমার এই বক্তব্যের উপলক্ষ। লেখাটির শেষ লাইনে সুনীল আমাদের বয়সিদের মরার ভয় ফাঁস করে দিয়েছেন। তাতেই ভয় পেলাম। আমার তো মরতেও ভয়। চিত্রগুপ্ত খাতা খুলে নাকি বলে থাকেন, ‘ও বাঙালি! ওদের একটা আস্ত রবিঠাকুর পাঠিয়েছিলেন স্যার। বেটারা তাও ভাষাটা বাঁচাতে পারল না।’ এখন নাকি পরলোকের নরকেও বাঙালিদের ঠাঁই দিচ্ছে না। যাদের ভাষা নেই তেমন অবোলালোকে একটা খোঁয়াড় শুধু পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। শুনে মরতে সাহস পাচ্ছি না।
সুনীলকে একটা বিষয়ে আশ্বস্ত করতে পারি। বাংলা ভাগ হবেই ও গোর্খাল্যান্ড বা কামতাপুর জাতীয় কিছু কোনও মতেই ঠেকানো যাবে না। ঠেকানোর জন্য মন বা মতের যে জোর দরকার, স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের কোনও সরকার তা দেখাতে পারেনি। সেই সব সরকার ইতিহাস-ভূগোল জানে না। তাদের কারও কোনও কাণ্ডজ্ঞানও পাহাড়ের ব্যাপারে দেখা যায়নি। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় পাহাড়ে সরকারের একটা সেক্রেটারিয়েট খুলেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে ঘন ঘন দার্জিলিঙে যেতেন। গোটা দশেক নেপালি শব্দ শিখেছিলেন। যে কোনও সভাতেই সেই শব্দগুলো আওড়াতেন। তাতে একটা হাস্যরস সৃষ্টি হত।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিমল গুরুঙ্গ। দার্জিলিং, ২০১১।
বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের আন্তর্জাতিকতাবোধ বড় রহস্যময়। তাঁরা অনেকে মনে করেন, বাঙালি হিসেবে কোনও কীর্তি বা অধিকারের দাবিদার হওয়া সংকীর্ণতার পরিচায়ক। এটা বামপন্থীদের মধ্যেই বেশি। প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বাঙালি হিসেবে রাষ্ট্রপতিপদে সমর্থনকে এই বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা ‘গেঁয়োমি’ বলে গাল পেড়েছেন। এঁদের মধ্যে অপ্রমাণিত এই এক গুজব-ইতিহাস চালু আছে যে, বাংলার পাহাড় যখন গোর্খাদের তৈরি তখন তারা তো স্বাতন্ত্র্য চাইতেই পারে।
বাংলার পাহাড় কার বাপের বাড়ি বা কার শ্বশুর বাড়ি সেই তর্ক মৃত্যুফাঁস। এক বার ফাঁসলে আর বেরোনোর কোনও উপায় নেই। স্বভাবত তর্কপ্রিয় হলেও এ-তর্কে আমি ফাঁসতে যাচ্ছি না। তর্ক করতে হলে আমরা ফাঁস দিচ্ছি ও সুনীলের মতো শান্তিপ্রিয় মানুষকেও উত্তেজিত করতে চাইছি।
পৃথিবীতে এমন অনেক জায়গা আছে যা ভৌগোলিক ভাবে উভভাষী। বাংলার পাহাড়ও তাই। এমন কোনও নেপালি-গোর্খালি মানুষজনকে আমি চিনি না, জানি না, যিনি বাংলা জানেন না। এখন যাঁরা সিঙ্গালিলা রেঞ্জের একটু ভিতর থেকে কিছু তরি-তরকারি নিয়ে হিলকার্ট রোডের দ্বারা চিহ্নিত এলাকায় সওদা করতে আসেন তাঁদের পিতৃপুরুষরা হয়তো বাংলা জানতেন না আর তাঁদের বাংলা ব্যবহারে হয়তো কিছু আড়ষ্টতা আছে। কিন্তু কোনও এমন শিক্ষক, উকিল, সরকারি-বেসরকারি কর্মী, গৃহকর্তা, গৃহকর্ত্রী, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগী, চা-বাগান কর্মী, ট্যাক্সিচালক, ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক, ডাক্তার জানি না, দেখিনি, যিনি বাংলা জানেন না। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের বর্তমান নেতা যাঁরা, বিমল গুরুঙ্গ প্রমুখ, তাঁরা নেপালি সংস্কৃতিরও খুব বড় মানুষ নন। তাঁরা অনেকে নেপালিও ঠিক মতো জানেন না।
একটা খবর দিই। সুনীলের ভাল লাগবে। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে এক সময় এমন একটা কথা চালু ছিল ছাপা কোনও বাংলা শব্দ সুনীলের চোখ এড়িয়ে যায় না। এখনও নিশ্চয়ই যায় না। কিন্তু এখন ওঁর পক্ষে সব স্বীকার করা হয়তো সম্ভব হয় না।
এই সে দিন একটা উপন্যাস আমার হাতে এল। ‘নুন চা’। লেখক বিমল লামা। সস্ত্রীক এক দিন এসে বইটি আমাকে দিলেন। আমার চেনা নন। দার্জিলিঙের ছেলে। ভূমিতুতো আত্মীয়তাবোধে দিতে এসেছেন। একটি উপ-শিরোনাম আছে, ‘চায়ের দেশের নুন কথা’। একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, ‘লিখেছেন উপন্যাস। দেখতে-শুনতে এত রহস্য কেন?’ স্বভাবত বিনয়ী লেখক কোনও জবাব দিলেন না। বুঝে যাই, সব কিছু তাঁর ইচ্ছে মতো ঘটেনি।
উপন্যাসটি পড়ে, সুনীল, আমি তাজ্জব। গত কয়েক বছরের সবচেয়ে ভাল বাংলা উপন্যাস লিখেছেন এক জন নেপালি-বাঙালি। কোনও ছোট কারণে যে নভেলটি এত ভাল, তা এক্কেবারেই নয়। সিঙ্গালিলা রেঞ্জের আনাচকানাচ এমন অনুপুঙ্খে এর আগে কোনও নভেলে আসেনি। সেটাও সবচেয়ে বড় কথা নয়। সেই আনাচ-কানাচের মানুষজনের, তাঁদের গোর্খালি পরিচয়ে বিশেষ কিছু আসবে যাবে না। নিজেদের ভিতরকার সম্পর্কের সব ভাঙচুর ও নকশা বাংলা নভেলের একটা বড় কীর্তি। কে সেই কীর্তি গড়েছেন? এক জন গোর্খা? না, এক জন বাঙালি?
সুনীলের সঙ্গে হাজার শতাংশ একমত হয়ে আমি একটা প্রস্তাব করছি। বাংলা ভাষা সবচেয়ে বেশি নষ্ট করে সরকারি বেসরকারি ব্যবহার। এয়ারপোর্ট থেকে সরকারি হল, আয়কর থেকে পাসপোর্ট, অফিস, রেলস্টেশন থেকে পুলিশ স্টেশন বাংলা নোটিসগুলি বোধগম্য ও সুষ্ঠু বাংলায় লিখতে হবে। সুনীল যদি চান, আমি ওঁকে উদাহরণ দেব। সেগুলো ভাষার পক্ষে অবমাননাকর। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট কয়েক মাস আগে একটা রায় দিয়েছে বাংলার অবমাননাকর ব্যবহার শাস্তিযোগ্য। আসুন, আমরা দাবি করি, জামিন-অযোগ্যও হোক। আমরা এমন উদাহরণ মিডিয়াকে দেব। কাগজগুলোকে বলব, ‘অপাঠ্য’ শিরোনামে কাগজের এক কোণে সেগুলো ছাপা হোক। অপাঠ্য নির্ধারকদের তালিকায় যদি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও সুকুমারী ভট্টাচার্য থাকেন, তবে অমান্য করলে নিলডাউন হতে আপত্তি কোর্টে টিকবে না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.