সম্পাদক সমীপেষু...
‘জাতীয় লজ্জা’, এখনও
সম্পাদকীয় নিবন্ধ ‘নীরব ঘাতক’ (৪-৫) প্রসঙ্গে এই চিঠি। আমাদের দেশের পাঁচ বছরের কম শিশুদের শতকরা ৪৩ জনই অপুষ্ট। তাদের বয়সের তুলনায় শারীরিক মাপের (BMI) যে অনুপাত, তার ভিত্তিতে এই হিসাব পাওয়া গেছে আমাদের দেশের ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে’ (NFHS)-এর তৃতীয় পর্যায়ের সমীক্ষা অনুযায়ী ২০০৫-’০৬ সালেই এই তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। গত ২০০৮ সালের ১৫ অগস্ট দিল্লির লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উড়িয়ে বক্তৃতা করার সময় আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, ‘এটা জাতীয় লজ্জা। এই লজ্জা আমরা দূর করব।’ তার সাড়ে তিন বছর পর জানুয়ারি ’১২-য় আবার তিনি ওই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে দিল্লিতে সেই কথাগুলি আবার বললেন। তার পরও পাঁচ মাস কেটে গেছে, আমাদের দেশের শিশুদের অবস্থা তেমনই শোচনীয় আছে।
কিন্তু কেন? দেশে কি সম্পদের অভাব আছে? না তো। জাতীয় আয় তো বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর ‘লজ্জা’ ঘোষণার সপ্তাহেই অর্থমন্ত্রী নির্মাণ শিল্পে অগ্রগতির তথ্য ঘোষণা করেছিলেন। কম হারে হলেও খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে, গুদামে খাদ্যশস্য পচছে। তবে! গড় জাতীয় আয় বলতে তো মুকেশ অম্বানী আর আমাদের গাঁয়ের পচা বাউড়ির আয়ের যোগফলের ভাগফল। তা দিয়ে গরিব মানুষের কী কাজ হবে? তাদের তো আর আয় বাড়ে না, বাড়ে তো বড়লোকদের। দেশ তাই তৃতীয় শক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখে, আর দেশের ৫২ ভাগ শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে। সারা দেশে প্রায় ২৩ কোটি অপুষ্ট মানুষ আছেন। তাঁদের সন্তানরাও জৈবিক ভাবেই অপুষ্ট।
দেশের শিশুদের এই দুর্দশা নিরসনের জন্য ১৯৭৫ সালের ২ অক্টোবর ‘সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প’ (আই সি ডি এস) চালু করা হয়। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই প্রকল্প বড় হয়েছে। এখন এই প্রকল্প পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পুষ্টি প্রকল্প। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৬টি পরিষেবা দেওয়া হয় পুষ্টিকর খাবার বিলি, শিশুদের প্রথাগত প্রাক্ প্রাথমিক শিক্ষাদান, প্রতিষেধক বিতরণ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যশিক্ষা দান এবং জাতীয় পরিষেবা। কিন্তু এই পরিষেবাগুলির মধ্যে যথেষ্ট গাফিলতি থাকার ফলে সাড়ে তিন দশক পরেও এ ধরনের সম্পাদকীয় লিখতে হয়।
আই সি ডি এস-এর অপ্রতুলতার জন্য ২০০০ সালে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল যে, ২০১২ সালের মধ্যে এই প্রকল্পকে সর্বজনীন করতে হবে। কিন্তু দুঃখের কথা, এর জন্য বরাদ্দ তেমন বাড়েনি। উদাহরণ, ২০১০-’১১ সালে মাত্র ৫৩৮ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে। একাদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বরাদ্দ করার কথা ছিল ৭২, ৪৭৭ কোটি টাকা। কিন্তু পরিকল্পনার চতুর্থ বছর পর্যন্ত বরাদ্দ হয়েছিল মাত্র ২৬,৯৯৮ কোটি টাকা। (সূত্র: ফ্রন্ট লাইন: ২৩ এপ্রিল ২০১০) ওই আর্থিক বছরে দেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ছিল গড় জাতীয় উৎপাদনের মাত্র ০.৮৯ শতাংশ। এই অবহেলার কারণে অবস্থা আরও মারাত্মক হয়েছে।
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের বেতন দেওয়া হয় না। দেওয়া হয় অতি সামান্য ভাতা। ওয়ার্কারদের সাড়ে চার হাজারেরও কম আর হেলপারদের তিন হাজারেরও কম। অবসরের বয়স নির্ধারিত থাকলেও কারও কোনও অবসরকালীন সুবিধা নেই। আর শিশুদের জন্যও বরাদ্দ অতি সামান্য চাল-ডাল-সবজি-ডিম। তাতে যদি প্রকল্প এলাকার সমস্ত শিশু যোগ দেয় তো কী হবে বলা যায় না। যদিও বলা আছে ৬ বছর পর্যন্ত শিশুদের বরাদ্দ ২ টাকা থেকে ৪ টাকা। খুব বেশি অপুষ্ট শিশুদের জন্য বরাদ্দ ২.৭০ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত। গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের জন্য বরাদ্দ ২.৩০ টাকা থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত।
আমার নিজের ব্লকের কথা বলি। ব্লকটি বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম-২। এখন পর্যন্ত এখানে মোট সেন্টার আছে ১৬২টি। এর মধ্যে ৮০টির নিজস্ব জায়গায় বাড়ি আছে। ২৮টি চলে প্রাইমারি স্কুলবাড়িতে। ৫৪টির কোনও বাড়িই নেই। ৫৬টিতে শৌচাগার আছে। ১১৩টিতে পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে। বাকি ৪৯টিতে নেই। বুঝুন, পানীয় জলও নেই, তো পুষ্টি!
শিশু ও তার মায়ের স্বাস্থ্য বিষয়ক আর একটি প্রকল্প হল, অ্যাক্টিভেটেড সোশ্যাল হেলথ অ্যাক্টিভিস্ট (এ এস এইচ এ) বা ‘আশা’ প্রকল্প। এই প্রকল্পের অ্যাক্টিভিস্টদের বেতন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। তাঁরা নাকি কমিশনে কাজ করবেন। বাকি থাকল মিড ডে মিল বা দ্বিপ্রাহরিক আহার প্রকল্পের কথা। ১ এপ্রিল ২০১১ থেকে এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ প্রাইমারির জন্য মাথাপিছু দৈনিক ২ টাকা ৮৯ পয়সা এবং আপার প্রাইমারির জন্য ৪ টাকা ৩৩ পয়সা। বর্তমান বাজারে তাতে কত পুষ্টি আসতে পারে? আরও মজা হল, বাজারে জিনিসের দাম বাড়ে, কিন্তু বরাদ্দ বাড়ে না।
অবশ্য শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই কাজ হয় না। তাই এর আগেও আনন্দবাজার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, শিশুপুষ্টির জন্য শুধু মাত্র দারিদ্র দায়ী নয়, অশিক্ষা ও চেতনাও দায়ী। পুষ্টি সম্বন্ধে চেতনা না-থাকায় অনেক সচ্ছল বাড়ির শিশুও অপুষ্ট। পুষ্টিকর খাদ্য খেলেও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করলে কৃমি, ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক ইত্যাদিতে তাকে অপুষ্ট করে তুলতে পারে। মায়ের এবং পরিবারের স্বাস্থ্যচেতনাও একটা শর্ত।
চিত্রটাও সারা ভারতের এক নয়। রাজ্যে রাজ্যে সাফল্য-ব্যর্থতার ফারাক আছে। আছে গ্রাম-শহরের ফারাকও। অপুষ্টি মোকাবিলায় আমাদের রাজ্যের সাফল্য অন্যান্য রাজ্যগুলোর তুলনায় যে ভাল, তা যোজনা কমিশন স্বীকার করেছিল। জাতীয় গড় এর চেয়ে সব বিষয়েই ভাল ছিল।
আমরা জানি, যোজনা কমিশন দেশে পুষ্টি প্রকল্প রূপায়ণের দিকটি খতিয়ে দেখতে অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প রূপায়ণ নিয়ে সমীক্ষা চালায়। ২০১১ সালের মার্চে ওই রিপোর্ট যোজনা কমিশনে জমা পড়েছে। দেশের ৩৫টি রাজ্যের ১০০টি জেলায় ১৯ হাজার ৫০০টি পরিবারে ওই সমীক্ষা চালানো হয়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, যদিও দেশে অপুষ্টি কাটাতে এই প্রকল্পকে আরও প্রসারিত করার দরকার ছিল, কিন্তু তা হয়নি। যে গরিব মানুষগুলোর এই সহায়তা দরকার ছিল, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৪১ শতাংশের কাছে তা পৌঁছেছে। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে নথিভুক্ত শিশুর হার দেশে ৫০ শতাংশ। খাবার মেলে ৩০ শতাংশের। যাতে অর্ধেক শিশুর নামই লেখা হয়নি। আর ৭০ শতাংশই খাবার পায় না। তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ এ জন্য ভাল যে, এখানে ৬০ শতাংশ নথিভুক্ত এবং খাবার পায় ৫০ শতাংশ শিশু। জাতীয় আয়ের চেয়ে ভাল হলেও এখনও অর্ধেক শিশু এ রাজ্যে প্রকল্পের আওতার বাইরে।
শুধু মাত্র কাউকে একতরফা দোষারোপ করা নয়, কাজ ধীরে হলেও দেশটা এগোচ্ছে। অপুষ্ট শিশুর সংখ্যাও ৫৩ থেকে ৪২ শতাংশে নেমে এসেছে। চাই আরও দ্রুত পরিবর্তন। শিশুদের জন্য আরও বরাদ্দ। চাই ভাল খাবার। দুর্নীতিমুক্ত বিতরণ ব্যবস্থা। আর মা বাবা-সহ দেশবাসীর সমূহ সচেতনতা। প্রয়োজনে ওই সব কেন্দ্রে নজরদারি। পরিকাঠামোহীন কেন্দ্রগুলির দুরবস্থা দূর করতে আমার-আপনার ভূমিকাও কম নয়!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.