|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
পুকুর কেটে কী হবে, যদি তাতে জল না থাকে |
কী হবে রেশন চালু রেখে, যদি অপুষ্টি দূর না হয়? কী হবে সর্বশিক্ষা মিশন চালিয়ে, যদি শিশুরা
লিখতে-পড়তে না শেখে? কী হবে স্বাস্থ্য মিশনে টাকা ঢেলে, যদি তা আরোগ্য না আনে? প্রকল্প মানুষের
জন্য
কী করতে পারল, ভুলে গিয়ে প্রকল্প চালানোটাকেই ‘কাজ’ বানিয়ে ফেলেছেন কর্তারা। লিখছেন স্বাতী ভট্টাচার্য |
এক কথায় প্রকাশ করুন: ‘মহাত্মা গাঁধী
জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প।’ উত্তর: ‘পণ্ডশ্রম।’ |
|
তাই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের বুকে এত খাদ। ওগুলো হওয়ার কথা ছিল পুকুর। গ্রামের মানুষ পুকুর সংস্কার করে তাতে ধরে রাখবেন বৃষ্টির জল, মাটির তলা থেকেও জল উঠে এসে ভরে দেবে পুকুরকে, এমনই ভাবা হয়েছিল। ছয় মাসও যদি জল থাকে, সেচের জলের চাহিদা মেটে অনেকটা, শ্যালো চালিয়ে জলস্তর ক্ষয় করতে হয় না। বাসন-মাজা কাপড়-কাচার জলের চাহিদা মিটে মেয়েদের জীবনটা খানিক সহনীয় হয়। সেই উদ্দেশ্যে একশো দিনের প্রকল্পের বেশির ভাগ কাজই এ রাজ্যে হয়েছে জলাশয় সংস্কারের প্রকল্পে। খরচ হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। গত সাত-আট বছরে যত পুকুর কাটা হয়েছে, তাতে জল থাকলে বহু জমি দোফসলি হত, বৃষ্টির জন্য আকাশ-পানে তাকিয়ে বসে থাকতে হত না চাষিদের। বৃষ্টি যথেষ্ট না হলেও তা অনেক গা-সওয়া হত।
|
পুকুর চুরির বহর |
আসলে ঘটছে কী? আষাঢ়ের এক সকালে, উত্তরখরা গ্রামে তার একটা নমুনা দেখা গেল। বীরভূমের বাহিরি-পাঁচশোয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের এই গ্রামটির নামেও খরা, কাজেও খরা। পাঁচশোয়া গ্রামের পুবে, গাজিডাঙার উত্তরে আর বাহিরির দক্ষিণে বিস্তীর্ণ প্রায় হাজার বিঘে জমি, শ্যালো পাম্প বসাতে গিয়ে সেখানে জলের নাগাল মেলেনি। হারু বাউরি, চণ্ডী বাউরি, রতন বাউরিদের ভরসা আকাশ আর পুকুর। সাড়ে ন’শো ফুট লম্বা আর ১৪০ ফুট চওড়া উত্তরখরা খাল সংস্কার করতে তাঁদের মতো ২৬০ জন লেগে পড়েছিলেন একশো দিনের কাজে। খানিক বৃষ্টিতে এঁটেল মাটি একটু নরম হয়েছে, পুরুষরা কোদাল চালাচ্ছেন, মেয়েরা ঝুড়ি করে মাটি নিয়ে পাড়ে ফেলে আসছেন। মাথাপিছু গড়ে ৬২ ঘন ফুট মাটি কাটলে ওরা পাবেন ১৩৬ টাকা মজুরি। কাজ হয় গ্রাম পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে। গরিবের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় রোজগার যাতে হয়, তাই প্রকল্পটি মূলত শ্রম-নির্ভর যে কোনও কাজের অন্তত ৬০ শতাংশ টাকা ধরতে হবে মজুরি খাতে। |
|
পণ্ডশ্রম? গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা যোজনার কাজ, বনগাঁ। ছবি: পার্থসারথি নন্দী |
আরও কতটা কাটতে হবে? ‘এখানে জলের লেয়ার আছে বারো ফুট তলায়। দশ ফুট মতো কাটলে খালে জল থাকত অন্তত অঘ্রান অবধি, আমন ধান ঘরে তুলেও গম, সর্ষে, আলু বোনা যেত,’ বললেন হারু, চণ্ডীরা। ‘কিন্তু তার জন্য ২০ দিন কাজ করতে হত কম করে। সে কি আর হবে? সাত দিনের বেশি কাজ হবে না।’ সুপারভাইজারও জানালেন, নয় দিন কাজ হওয়ার কথা এই খালে। সব গ্রামে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কাজ করতে হবে, তাই এমন ‘রেশন’ হচ্ছে কাজ যুক্তি দিচ্ছে পঞ্চায়েত। কিন্তু আসল কথাটা হল, জল নিয়ে মাথাব্যথা নেই কর্তাদের। বীরভূমেরই এক পঞ্চায়েত সচিব, যিনি পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজ করেছেন, স্পষ্ট বললেন, ‘এন আর ই জি এ নীতিতে যদিও সেচের পুকুরকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু আসলে এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সংখ্যার খেলা। মজুরিতে যত খরচ হবে তত ভাল। কত দিন কাজ দেওয়া হল, তা দেখতে গিয়ে জলসম্পদের কথা সবাই ভুলে যাচ্ছে। ব্লকে নানা ওয়ার্কশপে যাই, কই সেখানেও তো জলের কথা শুনি না।’
অপর একটি পঞ্চায়েতের সচিবও বললেন, ‘পুকুরে জল উঠবে না জেনেও কাজ দিতে হয়। না হলে এত কাজ কোথায়? উপরওয়ালারা তো বলেই দিচ্ছেন, ৫০ দিন কাজ দিতে হবে, কেমন করে দেবে আমার দেখার দরকার নেই।’ বোলপুরের কাছে দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজ করেছেন তিনি, বললেন এই দুই অঞ্চলে ৪০ শতাংশ মতো পুকুরে জল আছে। ‘বাকিগুলো জল থাকবে না জেনেও খোঁড়া হচ্ছে।’
|
চাষি নয়, লেবার |
উত্তরখরা খাল এ বারও ফুট ছয়েক গভীরতায় থমকে যাবে। তিন বছর আগে এই খালই কাটা হয়েছিল এন আর ই জি এ’র টাকায়। খানিক দূরে আড়াই-তিন বিঘে জুড়ে শালুকগড়া খালও সংস্কার হয়েছিল। তারও আজ সেই একই দশা, নীচে পাঁকটুকুও শুকিয়ে কাঠ। এর আগে যা হয়েছিল, এ বারও তাই হবে, ধান রোয়ার সময়ে জল পাওয়া যাবে ওই খালগুলো থেকে, কিন্তু কার্তিকে ধান তোলার সময়ে খালে জল থাকবে না, বিঘে প্রতি ফলন হবে বড়জোর পাঁচ-ছয় বস্তা (তিন কুইন্টাল)। খালে জল থাকলে আশেপাশের ৩০ বিঘে জমিতে দুটো ফসল হতে পারত, আফশোস করছিলেন ওরা। ‘হয় আমাদের এক মাস খুঁড়তে দিক, নইলে মেশিন নামিয়ে তলাটা কেটে দিক। আমরা মাটি ফেলে দেব,’ বিড়িটা ছুড়ে ফেলে বললেন সন্ন্যাসী বাউরি। কিন্তু শ্রমিকদের সুযোগ বেশি দিতে হবে বলে বুলডোজার ব্যবহারের সুযোগ নেই প্রকল্পে। তাই কোনও গ্রামেই যতটা কাটা দরকার পুকুর, ততটা কাটা হয়ে ওঠে না।
মহাত্মা গাঁধীর নামাঙ্কিত প্রকল্প বাউরি, মার্ডি, হেমব্রমদের ‘লেবার’ করে রেখে দিল। দিন আনি দিন খাই-এর বাইরে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ করে দিল না।
এই চিত্র সর্বত্র। বীরভূমের ৪৪টি গ্রামে একটি সমীক্ষা করেন অর্থনীতির গবেষক শুভাশিস দে, ২০১০ সালে। সময়টা ছিল অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর, সে বছর বর্ষা শেষ হওয়ার পরে পরেই। একশোটিরও বেশি এন আর ই জি এ-র পুকুর তিনি নিজে দেখেন। সেই গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিতে তার আগের চার-পাঁচ বছরে পুকুরের কাজে খরচ হয়েছিল এন আর ই জি এ-র জন্য বরাদ্দ টাকার ৭৪-৮৯ শতাংশ। তা সত্ত্বেও নতুন পুকুরের ৮৮ শতাংশে জল ছিল না, পুরনোগুলো তো প্রায় সবই শূন্য। সম্বৎসর জল থাকে, এমন পুকুর মেরেকেটে তিন শতাংশ। যদিও প্রায় ৩০ শতাংশ পুকুরের চারপাশে চাষের জমি ছিল, কিন্তু মাত্র ১১ শতাংশ পুকুরের জল পাচ্ছিলেন চাষিরা।
উত্তরখরার আদিবাসী পাড়ার মণি হাঁসদা, মালতী হেমব্রদের গ্রামের ডোবা কোটালগড়ায় বছর দুই আগে সাত দিনের কাজ হয়েছিল, কিছু দিন জল ছিল। এখন একটা গামছা ধোয়ারও জল নেই। ‘আগুন লাগলে চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে,’ বললেন ওঁরা। দেড়শো পরিবারের জন্য দুটি টিউবকল। পাশের ইটোন্ডা গ্রামের চন্দনা, তন্দ্রা রাজবংশীরা জানালেন, পাড়ায় দশ-বারোটা পুকুর, কোনওটায় জল নেই। সকাল ছ’টা থেকে ৯টা, দুপুর একটা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা ওঁরা টিউবকলে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ‘আর দু’তিন ফুট পুকুর কাটলে জল মিলত।’ উত্তরখরা খালের মাটি কাটতে কাটতে পঞ্চায়েত সদস্য সুন্দরী মার্ডি বললেন, ‘এখানে খানিক, ওখানে খানিক, এমনি কাজ দেয়। এক মাস কাজ না করলে জল দাঁড়াবে কী করে?’
|
কর্তার রসিকতা |
যতটা মাটি কাটলে জল দাঁড়ায়, ততটা কাজ হয় না কেন? কী ভাবে স্থির হয় কতটা মাটি কাটা হবে? এক পঞ্চায়েত সচিব বললেন, ‘নির্মাণ সহায়ক পুকুরটা মেপে নেয়, জেনে নেয় কত টাকা চেয়েছি, তার পর ঠিক করে কতটা কাটা হবে। জলস্তর দেখে পুকুর কাটা, তেমন
আমি দেখিনি।’ এন আর ই জি এ কমিশনার দিব্যেন্দু সরকার অবশ্য জানালেন, আট-দশ লক্ষ টাকার প্রস্তাব ব্লক বা জেলাকে দিয়ে মঞ্জুর করিয়ে দরকার মতো পুকুর খোঁড়া যায়। কিন্তু উপরের কর্তাদের দিয়ে কাজের প্রস্তাব অনুমোদন করানোর ঝামেলায় যেতে চায় না অনেক গ্রাম পঞ্চায়েত। আড়াই লক্ষ টাকার মধ্যে কাজের প্রস্তাব মঞ্জুর করতে পারে গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্মাণ সহায়ক, তাই তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় কাজ। তবে তিনি এ-ও স্বীকার করেন যে, পুকুর কাটা হয়ে যাওয়ার পর তা সত্যিই জলসম্পদ তৈরি করে গ্রামের মানুষের প্রয়োজন মেটাচ্ছে কি না, তা পরখ করার কোনও ব্যবস্থাই চালু নেই। গ্রামে নয়, রাজ্যে নয়, কেন্দ্রে নয়।
গরিবের সঙ্গে এমনই রসিকতা করেন দেশের কর্তারা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ঘোষণা করেছেন, এন আর ই জি এ প্রকল্পে দুর্নীতি আটকাতে হবে। মানে সরকার আরও কোমর বেঁধে দেখবে, কাগজের সঙ্গে কম্পিউটার, কম্পিউটারের সঙ্গে কাজ মিলল কি না। কাটা-মাটি পুকুর হয়ে উঠল কি না, তা কিন্তু দেখবে না। জুয়াচুরি ভারী খারাপ, বোকামি আরও ভয়ানক।
দুপুর গড়াতে রোদ গনগনে, গরম বাতাস উপরে উঠছে, উত্তরখরা খালের সামনে সেই কাঁপা বাষ্পের পর্দা চোখে যেন ধাঁধা লাগাল। ওই যে লোকটি কোঁকড়া চুল, কথা বলতে বলতে কোদাল চালাচ্ছেন ধাঁই ধাঁই, ওই আমাদের পঞ্চায়েত মন্ত্রী নয়? ওই যে সাদা-দাড়ি বৃদ্ধ মাথায় নীল গামছার ফেট্টি বেঁধেছেন, কাদামাটি তুলে দিচ্ছেন আর এক জনের ঝুড়িতে, ওনাকেই কি দেখিনি লালকেল্লায়? সাদা শাড়ি, কষে চুল-বাঁধা মেয়েটি ঝপ করে কাদামাটি ফেলে তরতর করে নেমে গেল নীচে, ওই দ্রুত হাঁটাচলা যে রোজ দেখা যায় টিভির পর্দায়। এখানে এঁরা কেন?
তবে কি এঁরা বুঝেছেন, নির্জলা পুকুর তৈরির সঙ্গে তাঁদের রাজনীতির কোনও তফাত নেই? হয়তো ওঁরাও জানেন, জলহীন পুকুর কাটার মতোই লাভ নেই রেশন ব্যবস্থা চালু রেখে যদি তাতে অপুষ্টি দূর না হয়, সর্বশিক্ষা মিশন চালিয়ে যদি তা শিশুদের লিখতে-পড়তে না শেখায়, গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনে টাকা ঢেলে যদি তা আরোগ্য না আনে। প্রকল্প মানুষের জন্য কী করতে পারল, সে কথাটা ভুলে গিয়ে প্রকল্প চালানোটাকেই ‘কাজ’ বানিয়ে ফেলেছেন দেশের কর্তারা। তাঁদের ‘কাজ’ মানুষের কতটা কাজে লাগে, তা টের পেয়েই হয়তো চড়া রোদে নির্জলা পুকুর কাটছেন একটা দিন। নেতা হলেও, মানুষ তো।
|
কৃতজ্ঞতা: তরুণ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম |
|
|
|
|
|