উজানি অসমের কোকরাঝাড় জেলায় আবার হিংসার আগুন। এ বার সে-হিংসার চরিত্র সাম্প্রদায়িক। এক দিকে বড়ো জনজাতির স্বায়ত্তশাসন প্রাপ্ত জনগোষ্ঠী, অন্য দিকে বাংলাদেশ হইতে অভিবাসী মুসলিম জনগোষ্ঠী। সামান্য প্ররোচনাতেই পরস্পরের উপর চড়াও হইয়া যাহাদের যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা পেশিশক্তি বেশি, তাহারা সেখানে আক্রমণে নামিয়াছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্রে প্ররোচনা সর্বদাই অকিঞ্চিৎকর হইয়া থাকে। তাহার মূলে থাকে পরস্পরের প্রতি দীর্ঘলালিত অনাস্থা, রাজনৈতিক বিভেদপন্থার ধারাবাহিক অনুশীলনে যাহা ক্রমে সঞ্চিত হয়। সেই সঞ্চিত বারুদস্তূপ কেবল একটি সংক্ষিপ্ত স্ফুলিঙ্গ-সংযোগের অপেক্ষা করে।
কোকরাঝাড়ের দাঙ্গায় ইতিমধ্যেই অন্তত ১৮ জনের মৃত্যু হইয়াছে, যাহাদের অধিকাংশই নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ। কোকরাঝাড়ের স্বশাসিত বড়োল্যান্ড আঞ্চলিক প্রশাসন কিন্তু দাঙ্গার জন্য অভিবাসী মুসলিমদের দায়ী করে নাই। বরং কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য রাজ্য সরকারকে আর্জি জানাইয়াছে এবং শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার জন্য সকল সম্প্রদায়ের কাছে কাতর অনুরোধ জানাইয়াছে। ইহা নিশ্চিত ভাবে ওই স্বায়ত্তশাসিত জনজাতীয় প্রশাসনের রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচায়ক। একই সঙ্গে ত্রাণ-শিবির খুলিয়া দাঙ্গা-কবলিতদের স্বস্তি দেওয়ার কাজটিও দক্ষতার সহিত করা হইতেছে। দাঙ্গা-ভীত দরিদ্র মানুষরা নিজেদের ভিটেমাটি ছাড়িয়া নিরাপত্তার খোঁজে দলে-দলে এই সব শিবিরেই আশ্রয় লইয়াছেন। সাম্প্রদায়িক পরিচয় নির্বিশেষে তাঁহাদের সকলের খাদ্য-পানীয়, ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করা হইয়াছে।
সমগ্র অসমেই জনবিন্যাসের কাঠামোয় বাংলাদেশ হইতে বেআইনি অনুপ্রবেশ যে গুণগত রদবদল ঘটাইয়া চলিয়াছে, তাহার প্রতিকূল প্রভাব সমাজে পড়িবেই। কৃষিজমির হস্তান্তর, কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ, ব্যবসা করিয়া জীবিকা নির্বাহের সুযোগও ক্রমশ সঙ্কুচিত হইতে থাকা অসমের ভূমিপুত্রদের সামনে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অনিশ্চয়তা কণ্টকিত ভবিষ্যৎকেই মেলিয়া ধরে। সীমিত সুযোগের জন্য তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা সকল দুর্ভাগ্যের জন্য অভিবাসী বা অনুপ্রবেশকারীদেরই শনাক্ত করিয়া বসে। মতলববাজ সংকীর্ণ রাজনীতির কারবারিরা এই পরিস্থিতিকেই বিভেদপন্থা উস্কাইয়া তুলিতে কাজে লাগায়। অসমে অভিবাসী-বিরোধী আন্দোলন ইতিপূর্বে একাধিক বার উন্মাদ হিংসা ও ধ্বংসের চেহারায় আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। অভিবাসীরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ হইতে আসায় এবং ভিন্নধর্মী হওয়ায় তাহাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা জাগাইয়া তোলাও অপেক্ষাকৃত সহজ হইয়া পড়ে। প্রশাসনকে তাই অতিরিক্ত সজাগ থাকিতে হইবে। দাঙ্গাকারীদের কঠোর হস্তে দমন করা প্রশাসনের কর্তব্য। কিন্তু সেটা আশু প্রশাসনিক কৃত্য। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আরব্ধ কিন্তু অধুনা অসমাপ্ত কাজগুলির দিকে এ বার নজর দেওয়া দরকার। বিদেশি নাগরিক শনাক্তকরণ ও বহিষ্কারের প্রকল্পটির কী হইল, তাহাও অনুসন্ধান করা দরকার। অনুপ্রবেশ যদি নিরবচ্ছিন্ন হয়, তবে অসমের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সমস্যাটিও অমীমাংসেয়ই থাকিয়া যাইবে। |