ধর্মের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির জানাইয়াছিলেন, যিনি অঋণী, তাঁহার পক্ষেই আনন্দে থাকা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে একই প্রশ্ন করিলে হয়তো একটি পরিবর্ধিত উত্তর পাওয়া সম্ভব। তিনি বলিতেই পারেন, সেই সরকারের পক্ষেই আনন্দে থাকা সম্ভব, যাহার পূর্বসূরি অঋ
ণী অবস্থায় শাসন শেষ করিয়াছে। তাঁহার পূর্বসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বামফ্রন্ট সরকার তাঁহাকে সেই আনন্দের অধিকার দেয় নাই। বামফ্রন্ট দীর্ঘ কাল ঋণ করিয়া বেহিসাবি খরচ করিয়াছিল। তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে সেই ঋণের বিপুল বোঝা পাইয়াছেন। মুখ্যমন্ত্রী বোঝাটি বহিতে নারাজ। তিনি স্বয়ং, এবং তাঁহার অর্থমন্ত্রী দফায় দফায় কেন্দ্রের দ্বারস্থ হইয়াছেন। কখনও অনুনয় করিয়াছেন, কখনও হুমকি দিয়াছেন। এমনকী, কেন্দ্রের সহায়তা না পাওয়ার অভিমানে তিনি গোড়ায় রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন করিতেও অরাজি ছিলেন। কিন্তু, কোনও অবস্থানই তাঁহার আর্থিক সমস্যা দূর করিতে পারে নাই। বরং, অন্য কয়েক জন মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সাহায্য পাইয়াছেন, অংশত অযাচিত ভাবেও। যেমন উত্তর প্রদেশের নবীন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব যে দাবি লইয়া দিল্লিতে আসিয়াছেন, যোজনা ভবন তাহা তো দিয়াছেই, ৮০০ কোটি টাকা বাড়তি দিয়াছে। কেন্দ্রের এই বদান্যতা কেন, তাহার নিশ্চিত উত্তর পাওয়া কঠিন, কিন্তু স্মরণ করা যাইতে পারে, অখিলেশ যাদব যাঁহার পুত্র, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই মুলায়ম সিংহ যাদবকে সঙ্গী করিয়াই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হওয়ার বিরোধিতা করিয়াছিলেন। এবং, রেকর্ড সময়ের মধ্যে মুলায়ম সিংহ নিজের অবস্থান পাল্টাইয়া শ্রীমুখোপাধ্যায়কে নিঃশর্ত সমর্থনের কথা ঘোষণা করিয়া দেন।
এক্ষণে একটি কথা স্পষ্ট শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবিটি যতই ন্যায্য হউক, তাঁহার দাবি আদায়ের পথটি কার্যকর হইতেছে না। স্পষ্টতই, যে প্যাঁচ-পয়জারে কেন্দ্র মুক্তহস্ত হয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি তাহার তুলনায় অতি সরলরৈখিক। ফলে, অখিলেশ যাদবরা যাহা চাহেন, তাহা অপেক্ষা কিছু বেশি লহিয়াই রাজ্যে ফিরিতে পারেন, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বার বার শূন্য হাতেই ফিরিতে হয়। অখিলেশ যাদবদের খেলার প্রতিভাটিই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে আয়ত্ত করিতে হইবে, তাহা নহে কিন্তু দাবি আদায়ের একটি কার্যকর পথ তাঁহার অবিলম্বে চাই। একই সঙ্গে তাঁহাকে স্মরণে রাখিতে হইবে, সামর্থ্যের সহিত সাযুজ্যহীন ব্যয়ের যে কু-অভ্যাস বামপন্থীদের এই ঋণসাগরে নিমজ্জিত করিয়াছিল, সেই অভ্যাসটির উত্তরাধিকার বহন করিলে চলিবে না। রাজ্যের স্বার্থেই তাঁহাকে কঠোর হইতে হইবে। খরচের রাশ টানিতে হইবে। প্রকৃত আর্থিক সংস্কারই একমাত্র পথ। সত্য, সেই পথ জনমোহিনী নহে। কিন্তু, রাজ্যের স্বার্থে এই পথে না হাঁটিয়া তাঁহার গত্যন্তর নাই।
তবে, এই মুহূর্তে একটি বৃহত্তর প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন। যে দেশের শাসনব্যবস্থার কাঠামোটি যুক্তরাষ্ট্রীয়, সেই দেশে কেন রাজ্যগুলিকে অর্থের জন্য আদৌ কেন্দ্রের দ্বারস্থ হইতে হইবে? নেহরু-জমানার এই এককেন্দ্রিক অভ্যাসটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র এখনও বহন করিয়া চলিবে কেন? পণ্ডিত নেহরু ‘দেশ গড়িবার’ ভার লহিয়াছিলেন। তিনি বোধ করিয়াছিলেন, এই কার্যে রাজ্যের নেতারা নিতান্তই অযোগ্য, ফলে উন্নয়নের দায়িত্ব, এবং তাহার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের রাশ কেন্দ্রের হাতেই থাকা প্রয়োজন। কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে রাজস্ব যে ভাবে বণ্টিত হয়, তাহা এই মানসিকতারই প্রতিফলক। যোজনা কমিশনের ন্যায় সংবিধান-বহির্ভূত প্রতিষ্ঠানও তাহাই। নেহরু-যুগের বহু নীতিই বহু পূর্বে গঙ্গাবক্ষে নিমজ্জিত হইয়াছে। এই এককেন্দ্রিক ব্যবস্থাটি টিকাইয়া রাখিবার অর্থ কী? যোজনা কমিশন যে অ-সাংবিধানিক ক্ষমতা ভোগ করে, তাহা রদ করা হউক। রাজ্যগুলির মধ্যে রাজস্ব বণ্টনের নূতন, কেন্দ্র-নিরপেক্ষ, ব্যবস্থা চালু হউক। রাজ্যগুলিকে তাহাদের হকের প্রাপ্য আদায় করিতেও কেন্দ্রের নিকট জোড়হস্ত হইতে হইবে, নরম-গরম রাজনীতির প্যাঁচ লড়াইতে হইবে এমন ব্যবস্থা আর টিকাইয়া রাখা চলে না। |