‘ফারাক গড়ে দেবে ব্যক্তিত্বই’
‘পুতুল’ হবেন না প্রণব, আশা সব পক্ষের
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ মাসে অন্তত এক বার দেখা করতেন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলের সঙ্গে। ভাবী রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, মাসে নয়, সপ্তাহে অন্তত একদিন তিনি দেখা করবেন তাঁর সঙ্গে।
সংবিধানে এটুকুই শুধু লেখা আছে যে, কিছু দিন অন্তর দেখা করে প্রধানমন্ত্রী সরকারের বিভিন্ন বিষয় রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করবেন। কিন্তু ক’বার দেখা করবেন, সেটি সংবিধানে বলা নেই। মনমোহন সিংহের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে বলা হচ্ছে, রাইসিনা হিলে চলে গেলেও প্রণববাবু সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাইরে চলে যাননি। সংবিধানে লেখা আছে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে সরকারের সিদ্ধান্ত জানাবেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি সরকারকে কোনও পরামর্শ দিতে পারবেন না বা রাষ্ট্রপতি কোনও পরামর্শ দিলে সরকার তা নিতে পারবে না, এমন কথা কোথাও বলা নেই। কংগ্রেসের একটি সূত্রের বক্তব্য, নীতি নির্ধারণের প্রশ্নে দীর্ঘদিনের সঙ্কটমোচনকারী প্রণববাবুর পরামর্শ প্রধানমন্ত্রী নিতেই পারেন। কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত, পবন বনশল এবং রাজীব শুক্ল, যাঁরা গত এক মাস ধরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে রাজ্যে-রাজ্যে সক্রিয় ছিলেন, তাঁরাই হবেন আপাতত রাষ্ট্রপতি ভবন এবং সরকারের মাঝখানে গুরুত্বপূর্ণ সেতু। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার মন্তব্য, “সংবিধানে কোথাও লেখা নেই, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতারা রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আড্ডা মারতে পারবেন না!”
বিজেপি অবশ্য বিষয়টিকে অন্য ভাবে দেখছে। তাদের আশা, ‘রাবার-স্ট্যাম্প’ রাষ্ট্রপতি হবেন না প্রণববাবু। দলের অনেক নেতা ঘরোয়া ভাবে বলেছেন, খুব শীঘ্রই এক সক্রিয় রাষ্ট্রপতিকে দেখবে গোটা দেশ। রাজ্যসভায় বিজেপির সংসদীয় উপনেতা রবিশঙ্কর প্রসাদের ভাষায়, “তিনি শুধু কংগ্রেসের নয়, বিজেপিরও রাষ্ট্রপতি। তাই কংগ্রেস চাইলেও তাদের এজেন্ট হিসেবে তিনি কাজ করবেন বলে আমরা মনে করি না।” সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাষ কাশ্যপও মনে করেন, “প্রণব মুখোপাধ্যায় রাবার-স্ট্যাম্প রাষ্ট্রপতি হবেন না। তিনি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক। ফলে সব দিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবেন।”
এই মুহূর্তে রাজধানীতে সবথেকে বড় আলোচনার বিষয়বস্তু একটাই। কেমন রাষ্ট্রপতি হবেন প্রণব মুখোপাধ্যায়? জৈল সিংহের মতো, যিনি রাজীব গাঁধীর সরকারকে বরখাস্ত করার ‘ষড়যন্ত্র’ করেছিলেন? না কি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের মতো, যিনি মন্ত্রিসভার অনুমোদন ছাড়াই ইন্দিরা গাঁধীর কথায় জরুরি অবস্থা জারি করে দিয়েছিলেন? শিক্ষাবিদ জোয়া হাসান অবশ্য মনে করেন, “নিজের ব্যক্তিত্বের জোরেই প্রণববাবু গোটা দেশ এবং দুনিয়ার কাছে একটি বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।”
শঙ্করদয়াল শর্মা যখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তখন যথেষ্ট সংখ্যা না থাকা সত্ত্বেও অটলবিহারী বাজপেয়ীকে সরকার গড়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। কারণ, বিজেপি তখন একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ছিল। সেটি নিয়ে দিল্লির রাজনীতিতে কম জলঘোলা হয়নি। শঙ্করদয়ালের পরের রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণনের সময় থেকে নিয়ম তৈরি হল, সরকার গড়তে গেলে লিখিত ভাবে জানাতে হবে পক্ষে কত জন রয়েছেন। বিজেপির আইনজীবী নেতা অরুণ জেটলি অবশ্য এটা নিয়ে মোটেই ভাবিত নন। তাঁর কথায়, “এই বিতর্কটাই অবান্তর। বিজেপি যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসে, তা হলে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের বাইরে গিয়ে আমাদের ডাকবেন না, এমন তো হতে পারে না। আবার বিজেপি যদি সেই সংখ্যা নিয়ে না আসতে পারে, তা হলে রাষ্ট্রপতি চাইলেও তাকে ক্ষমতায় আনতে পারেন না।”
তা হলে প্রতিভা পাটিলের সঙ্গে প্রণববাবুর ফারাক কোথায় হতে পারে বলে মনে করছেন দিল্লির রাজনীতিকরা?
সিংহভাগই একটি ব্যাপারে একমত। ফারাকটা ব্যক্তিত্বের। ব্যক্তি প্রণব সক্রিয় রাজনীতি থেকে আসছেন। তিনি অরাজনৈতিক কোনও ব্যক্তি নন। অবসরপ্রাপ্ত কোনও নেতা বা রাজ্যপালও নন। গোটা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ বহু রাষ্ট্রনায়ক বারাক ওবামা থেকে শেখ হাসিনা, তাঁকে চেনেন। ক’দিন আগে পর্যন্ত জি-২০ সম্মেলনে গোটা পৃথিবীর অর্থমন্ত্রীদের সঙ্গে ওঠাবসা করেছেন। দু’দুবার দেশের অর্থমন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রী হয়েছেন। এ হেন এক ব্যক্তিত্ব যখন রাষ্ট্রপতি হন, তখন তাঁর গুরুত্ব আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা হয়। দ্বিতীয়ত, ১৯৪৭ সালের রাষ্ট্রপতি আর আজকের রাষ্ট্রপতির মধ্যে সময়টা অনেক বদলে গিয়েছে। সংবিধানের মধ্যে থেকেও রাষ্ট্রপতির অতি-সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক ব্যবস্থা আগের তুলনায় অনেক দুর্বল হয়েছে।
রাজেন্দ্র প্রসাদ বা রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর মতপার্থক্য হয়েছে। কিন্তু কখনওই সেটি সংঘাতের পর্যায়ে যায়নি। আবার ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ ‘রাবার-স্ট্যাম্প’ রাষ্ট্রপতি হিসেবে মধ্যরাতে জরুরি অবস্থা জারি করে গোটা দেশের সমালোচনা কুড়িয়েছেন। নেহরু একবার স্পষ্টই বলেছিলেন, মন্ত্রিসভা এবং আইনসভার মধ্যেই ক্ষমতা নিহিত আছে। রাষ্ট্রপতি পদে নেই। কিন্তু নেহরু বলতেন, রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি বটে, কিন্তু সংবিধান তৈরির সময় তাঁকে কর্তৃত্ব ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
সেই কর্তৃত্ব নিয়েই প্রণববাবু রাইসিনা হিলে থাকবেন বলে মনে করছেন সকলে। অনেকেরই ধারণা, কংগ্রেসের ‘পুতুল’ হবেন না প্রণব। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তিনি সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেই পারেন। তবে তার মানে এই নয়, সব সময় তাঁকে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। কার্গিল যুদ্ধের সময় নারায়ণন যে ভাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তিন সেনাবাহিনীর প্রধানকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন বা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের আর্থিক পুনর্বিন্যাসের বিষয়ে খোঁজ নিতে সংস্থার সিএমডিকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, তার মধ্যে তো কোনও অন্যায় নেই! কিংবা এ পি জে আব্দুল কালাম যেমন লাভজনক পদের বিলটি ফেরত পাঠিয়ে প্রধানমন্ত্রীর থেকে সেটি পুনর্বিবেচনার আশ্বাস চেয়েছিলেন, তার মধ্যেও তো দোষের কিছু নেই! ফলে প্রণববাবু তেমন কিছু করলে আখেরে দেশেরই ভাল হবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.