তাঁর সহপাঠী ততদিনে ভারতীয় রাজনীতিতে একটা বড় নাম। প্রথম যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন, তখন তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন ‘মানা’। লিখেছিলেন, ‘আমি কীর্ণাহার থেকে মানা মজুমদার লিখছি। তুমি আমাকে চিনতে পারবে তো?’ জবাবে ‘মানা’র সেই বিখ্যাত সহপাঠী ‘পল্টু’ ‘মাই ডিয়ার মানা’ সম্বোধন করে লিখেছিলেন, ‘তোমাকে কি ভোলা যায়? কারণ, তোমার জামার পকেটে রুলের কালিতে যে লেখা থাকত মানা মজুমদার।’
|
নারায়ণপ্রসাদ মজুমদার |
এই ‘মানা’ হলেন নারায়ণপ্রসাদ মজুমদার। বাড়ি কীর্ণাহারের মেলেপাড়ায়।
এটুকুতেই অবশ্য ‘মানা’র পরিচয় শেষ হয়ে যাচ্ছে না। নারায়ণবাবু হলেন দেশের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সহপাঠী। কীর্ণাহার শিবচন্দ্র হাইস্কুলে পল্টু তথা প্রণববাবুর সঙ্গে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন তিনি। তার পর বাবার মৃত্যুতে অর্থাভাবে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু, মানাকে ভুলতে পারেননি সেদিনের পল্টু। তাই মাঝেমধ্যেই দু’জনের মধ্যে চিঠি আদানপ্রদান হয়েছে। ভারত সরকারের প্যাডে লেখা ওই সব চিঠিই আজ নারায়ণবাবুর কাছে অমূল্য সম্পদ। রাষ্ট্রপতির চিঠি বলে কথা!
আজ স্মৃতিমেদুর মানাবাবু। মনে পড়ে যাচ্ছে স্কুলজীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা। বলছিলেন, “জ্বর-জ্বালা যাই হোক না কেন, স্কুল কামাই করার উপায় ছিল না আমার। কারণ, স্কুল যাওয়ার পথেই বাইরে থেকে হাঁক পাড়ত পল্টু। দেরি হলেই ঘরের মধ্যে কখনও হাঁটু ভর্তি কাদা মেখে স্কুল ইউনিফর্ম বগলে ধরে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ত পল্টু। তার পর হাত পা ধুয়ে সে-ও তৈরি হত স্কুল যাওয়ার জন্য। বাধ্য হয়ে আমাকেও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়তে হত।” বহুবারই অনিচ্ছাসত্ত্বেও ‘পল্টুর’ চাপে স্কুলে যেতে হয়েছে ‘মানা’কে।
নারায়ণবাবু জানালেন, প্রতি শনিবার ছুটির পরে ছিল তাঁদের স্কুলে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের আয়োজন করা হত। প্রণববাবু সব সময় বিপক্ষে বলতে উঠে তাক লাগিয়ে দিতেন। ছাত্রদের তো বটেই, শিক্ষকদেরও প্রশংসা আদায় করে নিতেন। |
কয়েক বছর আগে নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র জঙ্গিপুর থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় আহত হন প্রণববাবু। ওই খবর জেনে প্রণবাবুর কুশল কামনা করে চিঠি লেখেন নারায়ণবাবু। উত্তরে প্রণববাবু তাঁকে ‘প্রিয়বন্ধু’ সম্বোধন করে লেখেন, ‘আমি এখন ভাল আছি। শীঘ্রই কীর্ণাহারের বাড়ি যাচ্ছি। দেখা কোরো।’ শুধু চিঠি লেখাতেই নয়, বন্ধুত্বের নিদর্শন ধরা পড়েছে প্রণববাবুর আচরণেও। নারায়ণবাবুর কথায়, “অধ্যাপনা থেকে মন্ত্রী হওয়া পর্যন্ত ওঁর সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু উনি যে আমাকে ভোলেননি, তার প্রমাণ ওঁর আচরণ। বছর দু’য়েক আগে ওঁর কনভয় মিরাটির দিকে যাচ্ছিল। তখন আমি মাঠ থেকে রাস্তা পার হচ্ছিলাম। আমাকে দেখেই উনি কনভয় থামিয়ে কাছে ডেকে কুশল জিজ্ঞাসা করেন। তাঁর বাড়িতেও যেতে বলেন।”
প্রণববাবুর বাড়িতে যাওয়া-আসা ছেলেবেলায় মানাবাবুদের ভালই ছিল। তিনি বলেন, “পল্টুদের বাড়ি লাগোয়া কুঁয়ে নদীর পাড়ে তখন অনেক তাল গাছ ছিল। গাছ থেকে পড়া পাকা তাল খেতে আমরা পল্টুদের বাড়ি থেকে হাজির হয়ে যেতাম নদীর পাড়ে। তারপর পল্টুর মায়ের হাতে তালবড়া দিয়ে মুড়ি খেয়ে পাকা তাল নিয়ে বাড়ি ফিরতাম।” এ সব কথা বলতে বলতেই ৭৮ বছরের এই বৃদ্ধ দুই চোখ ভিজে আসে। স্মৃতিমেদুর গলায় বলেন, “সে সময় স্কুল টিফিনের জন্য মাসে ছাত্র প্রতি চার আনা নেওয়া হত। দেওয়া হত মুড়ি-বাতাসা। কোনও কোনও দিন বাতাসার বদলে মিলত সেদ্ধ ছোলার ঘুগনি। পল্টু নিজের পয়সায় বাতাসা কিনে এনে সহপাঠীদের সঙ্গে ভাগ করে খেত।”
সেই সময়ের সহপাঠী আজ দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে আসীন হওয়ায় ‘ছাপোষা বন্ধু’ গর্বিত বোধ করছেন নারায়ণবাবু। আত্মীয়স্বজন নাতিনাতনিদের ডেকে ডেকে সে কথা বলছেনও। তাঁর কথায়, “শীঘ্রই অভিনন্দন জানিয়ে পল্টুকে চিঠিও দেব।”
‘মাই ডিয়ার মানা’ সম্বোধনে জবাব কি এ বারও পাবেন? অপেক্ষায় থাকবেন মানাবাবু।
|
ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি ও নিজস্ব চিত্র। |