সফল হওয়া কাকে বলে
তোমরা যারা ‘প্রস্তুতি’-র পাঠক, তাদের অনেকেই এখন জীবনের একটা অনিশ্চিত সময়ে দাঁড়িয়ে আছো। যারা সদ্য স্কুলের বেড়া ডিঙিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছ, তারা তো বুঝতেই পারছ, এটা একটা নতুন জীবন, নতুন পরিবেশ। যারা এখনও তত বড় হওনি, তারাও ভেবেই চলেছ, কী নিয়ে পড়লে ভবিষ্যতে সফল হতে পারবে, কোন পেশা কতখানি লাভজনক হবে। খেয়াল করে দেখবে, চিন্তার অভিমুখ সব সময় সাফল্যের দিকে। কিন্তু, ‘সাফল্য’ জিনিসটা আসলে কী, জীবনে ঠিক কী পেলে তবেই তাকে ‘সফল হওয়া’ বলে, সেটা এখনও স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারছ না। অনেক টাকা রোজগার করতে পারাকেই কি সাফল্য বলে? আর পাঁচ জন লোক যাকে উঁচু নজরে দেখে, তেমন এক জন মানুষ হতে পারাই কি সফল হওয়া? নাকি, সাফল্যের অন্য কোনও মানে আছে? লেখাপড়ার কথা বরং আজ থাক, আমরা সাফল্য নিয়ে, সফল হওয়া নিয়ে কয়েকটা কথা বলি।
তোমাদের বেশির ভাগকেই এখনও চার পাশের মানুষজন ‘ছোট’ বলে ভাবেন। ছোট, মানে যার ব্যক্তিত্ব এখনও সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। কিন্তু, তোমরা তো জানো, সেটা ঠিক নয়। তোমাদের পছন্দ-অপছন্দ আছে, পারা-না পারা আছে। তোমাদের কোনও বিশেষ বিষয়ে উৎসাহ আছে। আর আছে মূল্যবোধ কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, কোনটা নৈতিক আর কোনটা অনৈতিক, তা তোমরা বিলক্ষণ জানো। কাজেই, তোমরা যখন নিজেদের জীবন তৈরি করবে, সেই জীবনে তোমাদের ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন অবশ্যই থাকতে হবে। নিজের ব্যক্তিত্বের বিপ্রতীপ কোনও পেশা সমাজের চোখে, মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনদের চোখে সেটা যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন তোমায় ‘সফল’ করতে পারবে না। কারণ, সেই পেশা তোমায় সুখী করবে না। এই কথাটা মাথায় রেখে পথ চলতে আরম্ভ করো।
প্রশ্ন হল, তুমি কী চাও? তোমার চাওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি, কারণ তোমার পেশা একমাত্র তোমার জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হবে। তোমার মা হয়তো চান, তুমি ইঞ্জিনিয়ার হও। তুমি নিশ্চয়ই তোমার মা-কে খুব ভালবাসো। তোমার মা-ও তোমায় ভালবাসেন। কিন্তু, যদি ইঞ্জিনিয়ারিং তোমায় মোটেই আকৃষ্ট না করতে পারে, তবে মায়ের সঙ্গে তোমার এই পারস্পরিক ভালবাসাতেও এত জোর নেই যে তা তোমার বিষয়ের প্রতি অপছন্দকে আজীবন ঢেকে রাখতে পারবে। বরং, সারা জীবন একটা অপছন্দের বিষয়ের সঙ্গে ঘর করতে বাধ্য করার জন্য হয়তো একটা সময় তুমি তোমার মা-কেই দোষী ঠাওরাবে। এটা অপ্রিয় কথা, কিন্তু খুব সত্যি কথা। তার চেয়ে, নিজে যেটা চাও, সেটাই পড়ো। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেই সফল, আর ইতিহাস পড়লে চূড়ান্ত ব্যর্থ জীবনের সমীকরণ এত সহজ নয়।
অনেকেই বলবেন, এখন ভয়ানক প্রতিযোগিতার যুগ এক বার পা ফসকালেই সব শেষ। সত্যি কথাটা হল, আগে কখনও এত ভাল সময় আসেনি। এখন যে বিষয় নিয়েই পড়ো না কেন, সেটা ভাল ভাবে আত্মস্থ করতে পারলে তোমার চাকরির অভাব হবে না। হয়তো এম বি এ পড়ে চাকরি করতে গেলে যত মাইনে পাবে, ইতিহাস পড়ে তত টাকা পাবে না। শুরুতেও নয়, কখনওই নয়। কিন্তু, শুধু মাইনের টাকাতেই কি সাফল্যের মাপ হয়? যে বিষয়টা ভালবাসো, সেই বিষয়ের সঙ্গে থাকতে পারবে আজীবন খাওয়া-পরারও অভাব হবে না। সব মিলিয়েই তো ভাল থাকা। আর, ভালই যদি না থাকতে পারো, তবে সফল হবে কী ভাবে? আর একটা কথা হয়তো শুনেছি ‘এন্ট্র্যান্স বার্ন আউট’। যে বিষয়টা আসলে তোমার তেমন ভাল লাগে না, তাতেই ঢোকার চেষ্টা করতে করতে হয়তো শেষ পর্যন্ত ঢুকে পড়তে পারলে। কিন্তু, তোমার ভিতরটা এতই ক্লান্ত হয়ে গেল যে আর নতুন কিছু শেখার, নতুন কিছু করার ক্ষমতাই অবশিষ্ট থাকল না। তখন নিজেকে টেনে নিয়ে যাওয়াটাই একটা যুদ্ধ। নিজের জন্য অত কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করবে কেন, অকারণেই? একটা কথা আমাদের মাথার মধ্যে ঢুকে বসে থাকে কষ্ট না করলে কিছু পাওয়া যায় না। কথাটা ঠিক। কিন্তু, নিজের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করে যাওয়াটাকে এই কষ্টের পর্যায়ভুক্ত করা যায় না। এই কষ্ট আসলে নিষ্ঠা, একাগ্রতা। যে বিষয়টা ভালবাসো, তার প্রতি একাগ্র থাকার কাজটাও কিন্তু অনেক কম কষ্টের।
জীবনে যা হল, যা হল না, সব কিছুর জন্য অনেকে পরিস্থিতিকেই দায়ী করেন। কিন্তু, মানুষ মাত্রেই পরিস্থিতির দাস এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। এই দুনিয়ায় যাঁরা সফল তাঁরা পছন্দসই পরিস্থিতিটি
খুঁজে নেন, আর পছন্দের পরিস্থিতি না
খুঁজে পেলে নিজেরাই তা তৈরি করে নেন।

—জর্জ বার্নার্ড শ
জীবনে কারা সফল হবে, আর কারা হবে না? পরীক্ষায় ফার্স্ট না হতে পারলে, নিদেনপক্ষে গড়ের তুলনায় অনেক ভাল রেজাল্ট না করতে পারলেই কি আর সফল হওয়ার উপায় থাকে না? প্রচলিত অর্থে যাদের ‘ভাল’ বলা হয়, অন্যদের সামনে দৃষ্টান্ত হিসেবে যাদের তুলে ধরা হয়, তারা সাধারণত ভাল হয় পরীক্ষার জন্য যে এক বিশেষ ধরনের পড়াশোনার চর্চা, সেই জায়গাটায়। তাদের নিশ্চয়ই একটা বড় প্রশংসা প্রাপ্য। কিন্তু, কে ভাল কে ভাল নয়, কে সফল হবে আর কে হবে না, সেটা বিচার করার একমাত্র মাপকাঠি পরীক্ষার রেজাল্ট নয়। আরও অনেক রকম ভাল হতে পারে। যাকে বলে মালটিপ্ল ইনটেলিজেন্স। এটা কেবল কথার কথা নয়, সত্যি সত্যিই বাইরের জগতে অনেক বড় বড় সাফল্য পেয়ে থাকে এই সব ‘অন্য ভাল’ ছেলেমেয়েরা। বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসো কিংবা অ্যাপ্ল কোম্পানির প্রবাদপ্রতিম মালিক স্টিভ জোব্স, এরা কিন্তু পড়াশোনায় বেশ খারাপ ছিলেন। অতএব পরীক্ষায় ‘ভাল’ যে, তারই কেবল ভাল হয়, সেটা ভুল।
এই ‘অন্য ভাল’দের কেউ কেউ এমনিতে পড়ার জগতের ব্যাপারে আগ্রহী কিন্তু পরীক্ষার পড়ায় তেমন পারদর্শী নয়। তারা হয়তো ভাল রেজাল্ট করে না, কিন্তু পড়াশোনার একটা বড় জগতের সঙ্গে পরিচিত হয় বলে নিজেদের জীবনে পড়াশোনার নানা রকমের প্রয়োগ ঘটিয়ে সফল হতে পারে। ‘অ্যাকাডেমিক লাইনে’ পরবর্তী কালে যারা ভাল করে, তাদের অধিকাংশই কিন্তু এই দলের ভাল ছেলেমেয়ে। আবার কেউ কেউ আদৌ কোনও ধরনের পড়াতেই উৎসাহ পায় না, কিন্তু অন্যান্য কাজে ক্ষমতার পরিচয় দেয়, যেমন খুব ভাল গান করে, দারুণ দৌড়তে পারে, কিংবা অসাধারণ ছবি আঁকে। তাদের পারদর্শিতাও সেখানে, মনের টানও সেখানেই। পড়াশোনার চেনা ছকে তাদের বাঁধতে গেলে মুশকিল।
আবার কেউ কেউ থাকে যারা এই রকম কোনও একটি বিষয়ে বিরাট কোনও ক্ষমতা বা কৃতিত্ব দেখানোর মতো নয়, কিন্তু যাদের মধ্যে কতগুলি খুব জরুরি গুণ আছে, যা আমরা সচরাচর হয়তো খেয়ালই করি না। যেমন কেউ খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে। বা, কেউ খুব ভাল নেতৃত্ব দিতে পারে। একটা কাজ চাইলে কেউ হয়তো আরও অনেকগুলি ছেলেমেয়েকে এক জায়গায় করে তাদের দিয়ে কাজটা ভারী গোছালো, সুন্দর ভাবে করিয়ে নিতে পারে। এগুলোও কিন্তু বিরাট দক্ষতার ব্যাপার। এই আপাত-সাধারণ কিন্তু দরকারি দক্ষতাগুলো আমাদের সমাজে প্রশংসিত তো হয়ই না, তার খেয়ালও রাখা হয় না। গুণগুলো ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে হারিয়ে যায়। ‘মালটিপ্ল ইনটেলিজেন্স’-এর জায়গাটা ভীষণ জরুরি। আজকের সমাজে যে নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে, সেখানে এই অন্যান্য দক্ষতার দাম বিরাট।
আবার, আমরা অনেকেই তো এ রকমও হই যে কোনও কিছুতেই আমাদের তেমন দক্ষতা নেই। লেখাপড়ায় নিতান্ত মাঝারি, গাইতে পারি না, আঁকতে পারি না, নেতৃত্ব দিতে পারি না, তেমন খেলতেও পারি না। আমি কি তবে কখনও সফল হতে পারব না? মোটেই না। আমার পক্ষেও সফল হওয়া খুবই সম্ভব। কিন্তু, তার আগে, আমায় নিজের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করতে হবে। নিজেই নিজেকে জানাতে হবে, আমার মাপ কতটুকু, আমি ঠিক কতটুকু পারি। যতটুকু আমার পক্ষে সম্ভব, ততটুকু অর্জন করতে যে চেষ্টা লাগে, সেই চেষ্টায় ফাঁকি দিলে চলবে না। আমার সাধ্য যতখানি, ততটুকু পারাই তো সাফল্য। আমি নিজে জানব, আমার জন্য যে মাপকাঠি ধার্য করেছিলাম, তাকে ছুঁতে পেরেছি।
মোট কথা, সাফল্যের কোনও বাঁধা পথ নেই, কোনও বাঁধাধরা চেহারাও নেই। ডাক্তারি পড়তে গেলেই সফল আর আর্ট কলেজে ভর্তি হলে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার এই ধারণাগুলো বস্তাপচা। এ সব পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে। এই এগিয়ে যাওয়ার পথটা সব সময় মসৃণ না-ই হতে পারে। হয়তো মাসতুতো বোনের সঙ্গে বেজায় তুলনা করা হবে তোমার, সে কতখানি এগিয়ে আছে আর তুমি যে গোল্লায় যাচ্ছো, এই কথাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হবে। তুমি যদি নিজের মনে নিশ্চিত জানো যে তুমি যা চাও, যা পারো, সেই পথেই হাঁটছ, তবে এই সব কথায় কান দেওয়ার মোটে দরকার নেই। কিন্তু, নিজের কাছে জানাটা জরুরি।
খ্যাতি, অর্থ, যশ এর কোনওটাই আসলে সাফল্য নয়। এগুলো সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে আসে। না-ও আসতে পারে। সাফল্য আসলে মনের ব্যাপার একটা মানসিক অবস্থা। শুধুমাত্র নিজের মনেই জানতে পারা যায়, আমি সফল কি না। যে দিন তুমি সফল হবে, তোমার মনই তোমায় জানিয়ে দেবে। আর কারও বলে দেওয়ার অপেক্ষায় তোমায় বসে থাকতে হবে না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.