পঞ্চায়েত ভোট এগিয়ে আনার বিরুদ্ধে বামেরা। তাতে যে তারা ‘মুশকিলে’ পড়বে, শনিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণার পর রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএম ও অন্য বাম দলের নেতাদের কথায় তা স্পষ্ট।
এ দিনের দলীয় সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতার ওই ঘোষণার পর বিরোধী দলনেতা তথা সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “ভোট এগিয়ে আনার অর্থ সন্ত্রাসের পরিবেশে ভোট করে পঞ্চায়েত দখলের চেষ্টা করা।’’ সূর্যবাবুর দাবি, আগামী মে মাস পর্যন্ত নির্বাচিত পঞ্চায়েতগুলিকে কাজ করতে দিতে হবে। আরও একধাপ সুর চড়িয়ে প্রবীণ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষ বলেছেন, “কোনও ভাবেই পঞ্চায়েতের ভোট এগিয়ে আনা যাবে না!” ভোট এগিয়ে আনলে ফরওয়ার্ড ব্লক তার ‘সর্বাত্মক বিরোধিতা’ করবে বলেও অশোকবাবু জানান।
বস্তুত, বামেদের ধারণা ছিল, পঞ্চায়েত ভোট নির্দিষ্ট সময়েই অর্থাৎ ২০১৩ সালের মে মাসে হবে। সেই মতোই তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধি-সহ সরকার বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। তারপর শীতকালে ব্রিগেড সমাবেশ করে পঞ্চায়েতের ভোটে নামত বামফ্রন্ট। মমতার ঘোষণায় সেই পরিকল্পনা ধাক্কা খেল। এখন দ্রুততার সঙ্গে নীচুতলায় বামফ্রন্টের বৈঠক ডেকে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু করতে হবে।
আলিমুদ্দিনের নেতারা এ দিন দিল্লিতে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ব্যস্ত ছিলেন। তবে বিভিন্ন জেলার নেতারা মানছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতার ওই ঘোষণা করে তাঁদের রীতিমত মুশকিলে ফেলে দিলেন। বর্ধমানের অমল হালদার, উত্তর ২৪ পরগনার তড়িৎ তোপদার, দক্ষিণ ২৪ পরগনার রেজ্জাক মোল্লা বা উত্তরবঙ্গের অন্যতম নেতা অশোক ভট্টাচার্যের মতো রাজ্যকমিটির সদস্যরা মনে করেন, দ্রুত প্রার্থী বাছাই করতে হলে দলকে কিছুটা ‘অসুবিধা’য় পড়তেই হবে। ‘তৃণমূলের সন্ত্রাসে’র মুখে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে টিকে থাকার মত ‘কমিটেড’ প্রার্থীর খোঁজ করতে হবে। মে মাসে ভোট হলে (আরও একটি রাজ্য বাজেটের পরে) ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধী’ হিসাবে কিছু বাড়তি ‘সুবিধা’ পেত বামেরা। কিন্তু পুজোর পর ভোট হলে তা পাওয়া যাবে না।
আলিমুদ্দিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পরিস্থিতি যাই হোক, পঞ্চায়েত ভোটে যথাসম্ভব বেশি আসনে প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে শাসকদল হিসাবে তৃণমূল যতটা সুবিধা পাবে, ততটাই অসুবিধায় পড়বে সিপিএম। আগে বাম-প্রার্থী হলে জয়ের সম্ভাবনা যতটা বেশি ছিল, এ বার নানা কারণে পরাজয়ের সম্ভবনা ততটাই বেশি। ফলে একনিষ্ঠ বামকর্মী ছাড়া সিপিএম বা বামফ্রন্টের টিকিটে কেউ প্রার্থী হতে চাইবেন না। সমাজবাদী দলের নেতা তথা সাংসদ কিরণময় নন্দ বা সিপিআইয়ের মঞ্জুকুমার মজুমদারও একই অভিমত। গ্রামে গ্রামে একনিষ্ঠ বামকর্মী খুঁজতে নামতে হবে জেলার নেতাদের। শুধু তাই নয়, সব আসনে জেলা পরিষদ বা পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী পাওয়াও সমস্যা হতে পারে বলে মনে করছেন বাম নেতারা।
১৯৭৮-এ পঞ্চায়েত ভোটে বামফ্রন্টের বিপুল জয়ের পর থেকে প্রতিবার প্রায় এক বছর আগে থেকেই পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতিতে নামত সিপিএম। নিজেদের ক্ষমতা যাচাই করতে প্রয়োজনে শরিক দলকেও রেয়াত করত না। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটেও ছিল একই ছবি। কোন আসন কী ভাবে সংরক্ষিত হবে, বাম-জমানায় তা অনেকটাই অনুমান করে নিতেন জেলার নেতারা। সেই মতো সিপিএমের লোকাল কমিটিগুলি প্রার্থী বাছাইয়ে নেমে পড়ত।
এ বার পঞ্চায়েতে ৫০ শতাংশ আসন মহিলা সংরক্ষিত। কিন্ত কোন আসন মহিলা সংরক্ষিত হবে, কোন আসন তফসিলি জাতি-উপজাতির জন্য সংরক্ষিত হবে, কোন আসন সাধারণ হবে তা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ঘোষণার আগে সিপিএমের লোকাল কমিটির পক্ষে জানা বা আগাম অনুমান করা অসম্ভব। ফলে আগে থেকে প্রার্থী বাছাও সম্ভব নয়। সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনার এক নেতার কথায়, “সংরক্ষণের ফলে কী দাঁড়াবে, তা না-জানায় চূড়ান্ত অসুবিধায় পড়তে হবে। সম্ভাব্য সব রকম সংরক্ষণের কথা ভেবে ‘তিন সেট’ প্রার্থীর নাম আগে থেকে ঠিক রাখতে হবে। কিন্তু এত প্রার্থী কোথা থেকে পাওয়া যাবে?”
আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদক ক্ষিতি গোস্বামী মনে করেন, “দ্রুত প্রার্থী বাছাই করতে হলে বুথ-স্তর পর্যন্ত বামফ্রন্টের যে কমিটি রয়েছে, সেগুলিকে এখন থেকেই গুরুত্ব দিতে হবে। অবিলম্বে সেই কমিটিকেই প্রার্থী বাছাইয়ের কাজে নামতে হবে।” প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিপিএম নেতা অশোকবাবু অবশ্য এখনও মনে করছেন, “যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের ছ’মাসের বেশি আগে ভোট করা সম্ভব নয়, তাই ডিসেম্বরের আগে ভোট সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য কিছুটা বাড়তি সময় পাওয়া যাবে।” |