নায়ক। স্টার। সুপারস্টার। কিন্তু কেমন যেন ভঙ্গুর, পেলব।
ভাল না
বেসে উপায় কী?
‘অত ভালবাসা ভাল নয়’ বললে হবে? লিখছেন
অনিন্দ্য জানা |
যেন বাল্য-কৈশোর-যৌবন-কলেজ জীবনের দেওয়াল থেকে কিছু ফ্রেম ঝরে পড়ল টুপটাপ!— দেশপ্রিয় পার্ক লাগোয়া সিনেমা হলে দু’বছরের পুঁচকে। আশৈশব কঠোর অনুশাসনে-কাটানো জীবনে প্রথম হিন্দি সিনেমা: হাথী মেরে সাথী! হাতি নিয়ে ছবি, অতএব বালক-পাচ্য, হিন্দি ছবির অস্পৃশ্যতা নেই! সে ছবির টিকিট যে কত দুষ্প্রাপ্য আর মহার্ঘ ছিল, বোঝার ক্ষমতা তার ছিল না। ব্যাঙ্কের পদস্থ চাকুরে দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কাছে পেশার সুবাদে টিকিট ‘পৌঁছেছিল’। অতএব স্ক্রিনের সামনে মসৃণ অবতরণ। চার দশক পরে বর্ষণক্লান্ত এক কলকাতা-দুপুর যখন এক মৃত্যুতে ক্লিন্নতর, অন্তরের ভাঙচুর সামলাতে সামলাতে সেই বালক অগ্রজ সহকর্মীর অভিজ্ঞতা শুনবে, “বর্ধমানের মামার বাড়ির কাছের হল-এ গিয়ে হাথী মেরে সাথীর টিকিট পাইনি। সারা রাত কেঁদেছিলাম!”
ফ্রিজ ফ্রেম!
বাল্যকালে হস্তিদর্শনেই বেশি মনোযোগ ছিল (বড়রাও তেমনই চেয়েছিলেন)। কিন্তু যাঁর ঈশারায় অতিকায় ঐরাবত ঝুঁকে পড়ছে, তাঁর প্রতি একটা সম্ভ্রম তো তৈরি হয়েই যায়।
নাহ্, ঠিক সম্ভ্রম নয়। ভালবাসা।
এক দীর্ঘমেয়াদি আঠালো ভালবাসা। তাঁর চাহনির প্রতি। কী অদ্ভুত সৎ, অসহায়, বিষণ্ণ আর পেলব রোমান্টিকতা জড়ানো দৃষ্টি। মোমের আলোর মতো। থুতনিতে অগভীর খাঁজ। ফর্সা গালে দু’একটা ব্রণর ক্ষত। হাল্কা মাথা-নাড়া। এক দিকের ভুরুটা অল্প তুলে তাকানো। কমনীয় মুখ। ভুবনভোলানো হাসি। থরথর ভঙ্গুরতা। যে দৃষ্টি দেখে যৌবনে প্রেমে-বিফল মন ভাবে, যদি বলা যেত, ‘‘জিন্দেগি বড়ি হোনি চাহিয়ে। লম্বি নহি!” পেশাগত ঈর্ষা-ধস্ত জীবনে মনে মনে বলা যেত, “কুছ তো লোগ কহেঙ্গে...”
ফ্রিজ ফ্রেমই তো! |
শেষ। এবং শুরু। রাজেশ খন্না এবং অমিতাভ বচ্চন। ‘আনন্দ’। |
সুপারস্টার? হিরো? বলিউডের প্রথম সুপারস্টার? রোম্যান্টিক হিরো?
অতশত জানি না। জানতে চাই না। শুধু জানি, তাঁকে দেখে ‘আরাধনা’র পাইলট হতে চেয়েছি। ‘আনন্দ’-এর আনন্দ। বলতে পারেন, ও সব চরিত্র আর ডায়ালগ তো কাহিনিকার-চিত্রনাট্য লিখিয়েদের ক্রেডিট! হতে পারে। কিন্তু সে তো তর্কের কথা। তিনি অভিনয় না-করলে মনে থাকত? এত দিন?
হিরোসুলভ পেশি-টেশির বালাই নেই। বরং ঈষৎ পৃথুল চেহারা। অদ্ভুতদর্শন ড্রেনপাইপ প্যান্টের (ট্রাউজার্স-সুলভ আভিজাত্য যার নেই) উপর দিয়ে কলারওয়ালা গুরু পাঞ্জাবি। কখনও-সখনও আবার তার উপর দিয়ে চওড়া বেল্ট। এখনকার দিন হলে হিরোর পাশেও দাঁড়ানোর জায়গা পেতেন কি না সন্দেহ! পায়ে বেশির ভাগ সময়েই চটি। কখনও হাফ-স্লিভস শার্ট পরতে দেখেছি কি? মনে পড়ে না। হাতটাকে কনুই থেকে ভেঙে তিন বার ধাপে ধাপে মাথা নেড়ে হাফ টার্নে ফ্রেম ছেড়ে চলে যাওয়া।
সেই ‘ফ্রিজ ফ্রেম’টুকু হয়েই থেকে গেলেন তিনি!
মায়া হয়। ভারী মায়া হয়।
যেমন সত্তরের দশকের প্রথর্মাধে ‘টল-ডার্ক-হ্যান্ডসাম’ যে যুবক সত্তর মিলিমিটারে আবির্ভূত হয়ে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করে তারকার সংজ্ঞাটা আমূল নাড়িয়ে দেবেন, নরম রোমান্টিকতাকে দুমড়ে-মুচড়ে তাঁর ছুটি করে দেবেন, তাঁকে দেখে সমীহ হয়। বলতে ইচ্ছে করে, আমায় বাঁচাও!
কিন্তু এই লোকটা? তাঁকে দেখে বরাবর মনে হত, আহা রে! ও তো কিচ্ছু পেল না। একটু আলগোছে বুকে জড়িয়ে রাখি। সেলুলয়েডে একের পর এক ধাক্কা দেখাল। জীবনেও। সক্কলে ছেড়ে চলে গেল। প্রথমে দীর্ঘদিনের প্রেমিকা। তার পর বিবাহিতা স্ত্রী। শেষে লিভ-ইন করা বান্ধবী। জীবনটাকেও যে সত্তর মিলিমিটারে বাঁচতে চেয়েছিল, তার কী অসম্ভব ট্র্যাজিক পরিণতি! যে লোকটা ‘নমকহারাম’-এর প্রিমিয়ারে গিয়ে পর্দায় সহ-অভিনেতাকে দেখিয়ে পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়কে বলে, “দাদা, আমার সময় শেষ। নতুন লোক এসে গিয়েছে!” অন্তরালে চলে যাওয়ার পর সাক্ষাৎকারে বলে, “সে দিন বুঝলাম আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি, যে দিন থেকে বাড়িতে ফুল আসা বন্ধ হয়ে গেল।” মৃত্যুর কিছু দিন আগে দেড় মিনিটের একটা টিভি বিজ্ঞাপনে এসেছিলেন। হাহাকারের মতো অবয়ব। মাথা নেড়ে নেড়ে আলতো হাসিটা হেসে বলছেন বটে, “হাওয়া বদল সকতি হ্যায়। ফ্যান নহি।” কিন্তু ভাঙা গাল আর কাঁচাপাকা দাড়ির মুখটা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে আকুল অসহায়তা।
বান্দ্রা-র কার্টার রোডের বিখ্যাত বাংলোর ব্যালকনিতে ব্র্যান্ডেড ওভার-সাইজ্ড রোদচশমায় ঢাকা পড়ছিল সেই মুখ। ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা তুলে ঝাঁকুনি দিতে থাকা ‘ভি’ বলছিল, আমি আছি! আমি থাকব! না কি সেই ঝাঁকুনি মেলে ধরছিল নিজেকে রিভার্স গিয়ারে ফেলে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অসহায় এক আকুতি?
মাত্র ঊনসত্তরে চলে যাওয়ার পর দিকে দিকে তাঁকে ঘিরে স্মৃতিচারণার যে ঝড় উঠেছে, সেখানে সবচেয়ে বেশি শব্দব্যয় হল স্রেফ মহিলামহলে তাঁর ‘আবেদন’ নিয়ে। কী ভাবে মহিলারা তাঁর ছবিতে মালা দিয়ে বিয়ে করতেন। কী ভাবে তাঁর গাড়ির চাকার কাদা নিয়ে সিঁদুরের মতো সিঁথিতে পরতেন বা তাঁর গাড়ি লিপস্টিক-রঞ্জিত হত। খানিকটা লঘু করে দেওয়া হচ্ছে না? ছেলেরা তাঁকে আপন ভাবেনি? তাঁর সঙ্গে নিজেদের মিশিয়ে ফেলেনি? ছেড়ে যেতে উদ্যত প্রেমিকার চোখে চোখ রেখে, ভঙ্গুর হাসি হেসে মৃত্যুকেও রসিকতার সঙ্গে তুলনা করে তাঁর মতো করে বলতে চায়নি, ‘মওত ভি মেরে লিয়ে এক লতিফা হ্যায়!’
নইলে তাঁর অন্তে এমন আবেগের তুফান ওঠে দেশ জুড়ে? এই ঢেউয়ের মতো আবেগ তো ওই কমনীয় ভঙ্গুরতার জন্যই! যে ভঙ্গুরতা তাঁর লিপে তৈরি হওয়া অজস্র গানে। (অনুজ সহকর্মী বলছিলেন, “কিশোর-আরডি-রাজেশ ‘ত্রয়ী’ পরপারে। নির্ঘাত একের পর এক সুপারহিট গান তৈরি হচ্ছে”) বিদেশে স্কলারশিপ-অন্তে ফেয়ারওয়েল পার্টিতে স্টুলের উপর দাঁড়িয়ে ‘ইয়ে কেয়া হুয়া, ক্যায়সে হুয়া..’ গাইছে এক ভারতীয় যুবক। সাহেবরা সব মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে, শেষ হওয়ার পরেও ঘোর কাটছে না।
ফ্রিজ ফ্রেমই বটে!
পেশাগত প্রয়োজনে দিল্লিতে কর্মরত সাংবাদিক দেখা করতে গিয়েছে লোকসভার সাংসদের সঙ্গে। উপনির্বাচনে বিজেপি-র প্রার্থী এবং বলিউডি সতীর্থ শত্রুঘ্ন সিংহকে হারিয়ে জিতেছিলেন। লোদি এস্টেটের এম পি বাংলোর ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছেন। মাথায় কড়া কালো কলপ। পরনে কড়াতর ইস্ত্রির খদ্দরের সাদা কুর্তা-পাজামা। কাঁধ থেকে ঝুলছে তেরঙা উত্তরীয়। চোখে বড় সোনালি ফ্রেমের চশমা। জানালা দিয়ে বিকেলের রোদ এসে পড়ছিল। এক ঝলক তাকিয়ে বাঁ-প্রোফাইলটা মেলে ধরলেন ঠিকঠাক করে।
ফ্রেমটা ঠিকঠাক ফ্রিজ হল তো!
বাঙালি জেনে ঘাড়টা ঝুঁকিয়ে সেই হাসিটা হেসে বললেন, “বাবুমশাই?”
শেষ-জুলাইয়ের এক দুপুরে মুম্বইয়ের ভিলে পার্লের শ্মশানে যখন তিনি চলে গেলেন বাল্য-কৈশোর-যৌবন-কলেজ জীবনের ঝরে-পড়া ফ্রেমগুলো সঙ্গে নিয়ে, মাঝবয়সী বালক অস্ফুটে বলছিল— বাবুমশাই, এত ভালবাসা ভাল নয়! |