ভিড় মানে কী? নিছকই মনুষ্যপুঞ্জ? নির্দিষ্ট কোনও স্থানে একত্রিত এবং কখনও স্থির, কখনও চলমান কিছু মনুষ্যের সমাহার? তাহার শুধুই বুঝি আকার? মন নাই? ভিড় কি আসলে হৃদয়হীন? এমন কথা জিজ্ঞাসে কোন জন? ভিড়ের ভিতরে বিদ্যমান যে একক ব্যক্তি, ধরা যাউক কোনও যুবাপুরুষ, আসলে বহু জনতার মাঝে অপূর্ব নির্জন, ভিড়ের ভিতরে কখনও কি তাঁহার উদ্দেশে অন্য কোনও ‘একাকিনী’ বলিতে পারিবেন, পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ? তর্ক উঠিবে, লোকারণ্যে কি পথ-হারানো সম্ভব? অভিজ্ঞতা বলিবে, সম্ভব। কারণ, ভিড়ের ভিতরে সর্বদা নিজস্ব ইচ্ছামাফিক গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন। মাঝে মাঝে অতীব কঠিন। কারণ, অনেক সময় ভিড়েরও একটি গন্তব্য থাকে। সেই গন্তব্যের উদ্দেশে, নির্বিকার চিত্তে, তাহা আগাইয়া চলে। তখন নিজেকে, প্রায় অসহায় ভাবেই, ভিড়ের হস্তে সমর্পণ করিতে হইবে। সেই আত্মসমর্পণ কার্যত বাধ্যতামূলক। জনস্রোত যে দিকে চলিবে, তাহাই গন্তব্য। হইতে পারে সেই জনস্রোতটি শৃঙ্খলাবদ্ধ, হইতে পারে বিশৃঙ্খল। কিন্তু তাহার গতিরেখাকে অস্বীকার করিয়া অন্য দিকে চলিবার কোনও উপায় নাই। |
অর্থাৎ, ভিড়েরও একটি মন আছে। একটি মন না অনেক মন? অনেক মনের একটিই গতি? মানসাঙ্ক কী বলে, তাহা বলা কঠিন। মনের গতি কে-ই বা কবে স্থির নিশ্চয়ে বুঝিতে পারিয়াছে? কিন্তু, শারীরিক চলন অনেক সময়েই একটি নির্দিষ্ট দিকে। মহাষ্টমীর লোকপ্লাবন বা ব্রিগেড সমাবেশের জনতা, যখন রাস্তাই একমাত্র রাস্তা, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাহার অভিমুখটি নির্দিষ্ট। কারণ, ভিড় অনেক সময়েই কোনও না কোনও বিশেষ আবেগ বা অনুভূতি ভাগ করিয়া লয়। ভিড়স্থ জনসমষ্টি ‘সহমর্মী’-ও বটে। প্রচলিত অর্থে নহে, একটি বিশেষ অর্থে। তাঁহারা সকলে একটি বিশেষ আবেগের অংশীদার, সেই জন্যই না গৃহকোণ ছাড়িয়া এই বিশেষ জনারণ্যে শামিল! উৎসবের সময় তাঁহারা উৎসবমত্ত জনতার সহচর। রাজনৈতিক সমাবেশের সময় নেতা বা নেত্রীই দ্রষ্টব্য। অন্য সময়, বিশেষ কোনও তারকা আসিলে তাঁহারাও দর্শনের লক্ষ্য। ইহাই সহ-মর্মিতা! আমি চাহি। তুমি চাহ। সে চাহে। আমরা চাহি। অতএব, চালাও পানসি বেলঘরিয়া!
অন্তিমে একটি প্রশ্ন। ভিড় জমিতে কতক্ষণ সময় লাগে? সত্য, ইহা নির্ভর করে স্থান এবং কালের উপর। কথিত আছে, একদা কলিকাতার এক তরুণ কবি নাকি মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় একটি সুখ্যাত প্রেক্ষাগৃহের সম্মুখে দাঁড়াইয়া সহসা আকাশপানে চাহিয়াছিলেন। কয়েক মুহূর্তের ভিতর আশেপাশে ‘ভিড়’ জমিল। সবাই আকাশের দিকে চাহে। কেহ জানে না, কেন। অর্থাৎ, ভিড়ের ‘মন’ থাকে। আচমকা দুর্ঘটনা দেখিয়া আহত ব্যক্তির পার্শ্বে যে ভিড় জমা হয়, তাহার মন আছে। সেই ব্যক্তিকে একাকী ফেলিয়া যে ‘ভিড়’ অদৃশ্য হইয়া যায়, তাহারও। তখন সেই স্রোতের বিপরীতে কেহই হাঁটেন না, এমন নহে। ভিড়ের মধ্য হইতে কেহ সেই আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসাকেন্দ্রে লইয়া যান, কখনও কখনও। সে সকল অবশ্য ব্যতিক্রম। স্বাগত ব্যতিক্রম। |