দিল্লি ‘নিশ্চিন্ত’। কলকাতা ‘ক্ষুব্ধ’।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আজকের শহিদ সমাবেশ দেখার পরে কংগ্রেসের দুই পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া এমনই।
বস্তুত, ধর্মতলার সমাবেশ দেখে সনিয়া গাঁধী তথা কংগ্রেস নেতৃত্ব শুধু নিশ্চিন্তই নন, ‘মুগ্ধও’। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করছেন, কলকাতায় আজকের সমাবেশ প্রমাণ করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তায় এখনও ভাঁটা পড়েনি। একই সঙ্গে মমতা যে এখনই ইউপিএ ছাড়ছেন না, তাঁর আজকের বক্তব্য থেকে সেটাও স্পষ্ট বলেই মনে করছেন কংগ্রেস নেতারা। কারণ, শরিক হিসেবে যোগ্য সম্মান চেয়েও এবং সুদ মকুব নিয়ে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েও তিনি বলেছেন, কেন্দ্রে কংগ্রেসের সঙ্গে ‘ছিলাম, আছি, থাকব’।
সেই মমতাই কিন্তু রাজ্যে আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে ‘একলা চলো’র কথাও বলেছেন। আর তাতেই ক্ষুব্ধ প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব। তাই তাঁর ঘোষণার পর প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য উল্টে তৃণমূলকেই ‘বিশ্বাসভঙ্গকারী’ বলে আক্রমণ করেন। প্রদীপবাবুর বক্তব্য, “একসঙ্গে জোটে লড়ে মানুষের জন্য কাজ করার শপথ নিয়েছিল কংগ্রেস-তৃণমূল। সরকারও গড়েছিল। এখন পঞ্চায়েতে একলা চলার কথা বলে মানুষের কাছে বিশ্বাসভঙ্গ করল তৃণমূল।” একই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দেন, “ওরা একলা লড়তে চাইলে আমরাও প্রস্তুত। কংগ্রেস বিন্দুমাত্র শঙ্কিত নয়।” কংগ্রেসের তরফে আগেই অবশ্য তাদের ‘শক্ত ঘাঁটি’ মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুরে ‘একলা চলা’র ঘোষণা করা হয়েছিল। এ দিন প্রদীপবাবুর বক্তব্য জেনে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের পাল্টা বক্তব্য, রাজ্যে সম্প্রতি ছ’টি পুরসভার ভোটেও জোট হয়নি। এবং তার জন্য দায়ী ছিল কংগ্রেসই। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “কংগ্রেসের অনড় মনোভাবের জন্যই জোট ভেঙেছিল। তবুও তৃণমূল একলা লড়ে খুব ভাল ফল করেছিল।”
প্রদেশ নেতারা মনে করছেন, মমতা রাজ্য থেকে সিপিএমের পাশাপাশি কংগ্রেসকেও নিশ্চিহ্ন করতে চান। এই পরিস্থিতিতে তাই জনস্বার্থের বিষয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে রাজ্যের নেতাদের বাধা দেবে না হাইকম্যান্ড। তবে দিল্লিতে মমতা যে হেতু কংগ্রেসের সঙ্গ ত্যাগ করছেন না বলেই মনে করা হচ্ছে, তাই কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতারা মমতার বিরুদ্ধে আক্রমণে যেতে নারাজ। পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত এআইসিসি নেতা শাকিল আহমেদ তাই বলেছেন, “মমতা ভুল কিছু বলেননি। উনি জোটে থাকার শর্ত হিসেবে পারস্পরিক সম্মান চেয়েছেন। কংগ্রেসও সম্মান চায়। কিন্তু ভুললে চলবে না, উনি প্রণব মুখোপাধ্যায়কেই ভোট দিয়েছেন। এতে ইউপিএ-র জোট আরও মজবুত হয়েছে।” তবে তাঁদের ধারণা, সঙ্গে থাকলেও রাজ্যের দাবিদাওয়া নিয়ে চাপ বাড়াবেন মমতা। এ দিন তিনি সুদ মকুব নিয়ে ‘দিল্লি চলো’র কথা বলে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশ তাই বলছেন, “দুই শরিকের মধ্যে মতপার্থক্য হতে পারে। কিন্তু আলাপ আলোচনা করে তা মেটানো সম্ভব।”
আজকের ধর্মতলার সমাবেশ দেখে কংগ্রেসের নেতাদের মূল্যায়ন হল, পশ্চিমবঙ্গে মমতার রাজনৈতিক পরিসরে এই মুহূর্তে কারও পক্ষেই থাবা বসানো মুশকিল। তাঁর জনপ্রিয়তা এখনও তুঙ্গে। আর এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সলমন খুরশিদ তাই বলেন, “মমতার মতো জনপ্রিয়তা শুধু পশ্চিমবঙ্গে কেন, সারা ভারতেই বিরল। সিপিএমের বিরুদ্ধে তিনি যে ভাবে আন্দোলন করে ক্ষমতায় এসেছেন, গোটা দেশে আর কেউ তেমনটা করতে পারেননি।”
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে সাম্প্রতিক মতপার্থক্য এবং শেষবেলায় ‘দুঃখের সঙ্গেই’ প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থনের পরে আজ দলীয় মঞ্চে মমতা কী অবস্থান নেন, তার দিকে শুধু কংগ্রেস নয়, বিজেপি এবং বাম নেতারাও চোখ রেখেছিলেন। মমতার কথা শুনে দিল্লির কংগ্রেস যেমন নিশ্চিন্ত, তেমনই আশাহত বিজেপি ও বাম নেতারা। বিজেপি চেয়েছিল, কংগ্রেস-তৃণমূলে দূরত্ব তৈরি হোক এবং ত্বরান্বিত হোক ইউপিএ-র ভাঙন। আজ কেন্দ্রের সঙ্গে থাকার কথা বলে তাদের হতাশ করেছেন মমতা। তবে এর মধ্যেই রাজ্যে তৃণমূলের একলা চলার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বিরোধ উস্কে দিতে চেয়েছেন বিজেপি নেতা শাহনওয়াজ হুসেন। মমতা যাতে ইউপিএ-র উপর থেকে সমর্থন তুলে নেন, সে জন্য ডাক দিয়েছেন তিনি। আবার মমতা এবং কংগ্রেসের মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে সফল না হওয়ায় বামেরাও হতাশ। প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন করে কংগ্রেসের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের মুখবন্ধ করে রাখা বামেদের মমতা প্রথম ধাক্কা দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি ভোটে ইউপিএ-র সঙ্গে থেকে। আজ কেন্দ্রকে সদর্থক বার্তা বামেদের ফের আশাহত করলেন মমতা। এর পরে মমতাকে কটাক্ষ করেই খুশি থাকতে হচ্ছে বামেদের। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র আজ দিল্লিতে বলেছেন, “কেন্দ্রের সরকারে ওঁদের ছ’জন মন্ত্রী আছেন। আবার তিনি আন্দোলন, অবস্থানের কথাও বলছেন। কথা শুনে মনে হচ্ছে, ওঁর রাজনীতিটা হচ্ছে, গাছেরও খাব, তলারও কুড়োব।” এটা কংগ্রেস ও তৃণমূলের ‘ঘরোয়া বিষয়’ বলে মন্তব্য করে সূর্যকান্ত বলেন, “আমরা এ সবে নাক গলাই না। কিন্তু ওঁদের কোন্দল এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে পাড়া-প্রতিবেশীদের টেকা মুশকিল হয়ে যায়। আমাদের মুশকিলটা সেখানেই।” |