উদোর কথা বুধোর মুখে
পুজোর সময় পত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে। বাছাই করা লেখকদের কাছে বাছাই করা লেখা চেয়েছেন সম্পাদক। গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ নয়, হাসির লেখা, মজার লেখা।
মেরিলিন মনরো
সুকুমার রায়
তাঁদের এক জন নির্দিষ্ট তারিখের দিন দশেক পরে যেমনটি দস্তুর আর কী লেখা নিয়ে গুটিগুটি এসে বসলেন সম্পাদকের সামনে। দু’জনে পুরনো বন্ধু। সম্পাদক বললেন, ‘দাও, দেখি, কেমন লিখেছ।’ তার পর নিবিষ্ট চিত্তে পড়তে লাগলেন। পড়েন আর মিটিমিটি হাসেন। বেশ লাগছে, বোঝাই যায়। তবু লেখকের মন বন্ধুর পড়া শেষ হতেই উৎসাহী কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘কেমন হয়েছে?’ সম্পাদক মুচকি হেসে বললেন, ‘বেশির ভাগটাই তো পরশুরাম, ও জিনিসের তো জবাব নেই!’
না, লেখক মোটেই কুম্ভীলকবৃত্তির বশীভূত হননি, সে জিনিস তাঁর ধাতেই ছিল না। তিনি একটা স্টাইলে তাঁর রম্যরচনাটি লিখেছিলেন। সে ভারী অদ্ভুত স্টাইল। কয়েক লাইন লেখেন, আর অমনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে রাজশেখরবাবু যা লিখেছিলেন তার কোনও তুলনা নেই’, বলে আর একখানা লম্বা-চওড়া কোটেশন। তো, সম্পাদকের কটাক্ষে কিছুমাত্র বিচলিত হলেন না তিনি, হাসিটা আরও এক বিঘত চওড়া করে বললেন, ‘পড়তে খাসা লাগছে না? বলো? আসলে কী জানো ভায়া, বুড়ো হয়েও ছোটবেলার অভ্যেসটা আর ছাড়তে পারি না। স্কুলে বাংলার মাস্টারমশাই বলে দিয়েছিলেন, নিজের কথা বেশি লিখবি না, যত পারিস কোটেশন দিবি, একটু-আধটু ভুল হলেও ক্ষতি নেই, অত কেউ পাইপয়সা মিলিয়ে দেখতে যাচ্ছে না।’
রসিক মানুষ,
মোহনদাস
কর্মচন্দ গাঁধী
চার্লি চ্যাপলিন
কথাটা রঙ্গচ্ছলেই বলেছিলেন, কিন্তু উদ্ধৃতি সত্যিই আমাদের মজ্জাগত। আমরা কথায় কথায় ‘কোট’ করতে ভালবাসি। কেন? মহাজনের কথাকে নিজের কথার সাফাই হিসেবে কাজে লাগাতে চাই বলে? ‘কত জানি’র গৌরব? সস্তায় বাজিমাত করার উদগ্র বাসনা? হয়তো সবগুলোই। তবে এই বাসনাটি অবশ্যই দেশজয়ী, কালজয়ী। তা না হলে কি আর বাজারে কোটেশনের বইয়ের এমন কাটতি? ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউয়ে হাজার হাজার কোটেশনের সাইট? সকাল হতে না হতেই মোবাইলে নিদেনপক্ষে পঁচিশটা ‘কোট অব্য দ্য ডে’? সব দেশেই মনে হয় মাস্টারমশাইরা ছোটবেলা থেকে অভ্যেসটা মগজে ঢুকিয়ে দেন।
মাস্টারমশাই মিলিয়ে দেখলে স্কুলের খাতায় পনেরো আনা কোটেশনই ফেল করে যেত, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আর, পাশ করবেই বা কী করে? সব মনীষীর সব কথা কি ওই রকম হুবহু মনে রাখা যায় নাকি? তাঁরা নিজেরা ঠিক ঠিক বলতে পারতেন? স্বামী বিবেকানন্দের শোনা যায় অস্বাভাবিক স্মৃতিশক্তি ছিল, কিন্তু তাঁকেও যদি সক্কাল সক্কাল আচমকা ‘হে ভারত ভুলিও না...’ আগাগোড়া মুখস্থ ধরা হত, একশোয় একশো পেতেন? সন্দেহ আছে। যারা একটু সাহসী গোছের, তারা অতএব পরীক্ষার খাতায় দু’চার বার ‘তাই তো কবি লিখিয়াছেন’ বলে নিজের কথাই সাধুভাষায় চালিয়ে দিত। আজকাল অবিশ্যি আর তার কোনও সুবিধে নেই, সব উত্তরই তো দু’চার লাইনের। তা-ও বুঝি আর থাকে না মহামান্য উচ্চশিক্ষামন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, সব অবজেকটিভ হো যায়েগা। হায় কোটেশন, তোমার দিন গিয়াছে।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
অথচ, ভেবে দেখলে, উদ্ধৃতিই সকল বিদ্যার জননী। কী প্রাচ্যে, কী প্রতীচীতে। বেদের অন্য নাম শ্রুতি, গুরুশিষ্যপরম্পরায় শ্রুত এবং উদ্ধৃত হয়ে চলতে চলতেই সেই বিদ্যা সংরক্ষিত হয়েছে। আবার ও দিকে তাকালেও একই ছবি সোক্রাতেস নিজে কিছুই লিখে যাননি, অন্তত তেমন কিছু পাওয়া যায়নি কোথাও, তাঁর ভূরি ভূরি ‘ডায়ালগ’, সবই তাঁর শিষ্যদের, বিশেষত প্লেটোর দ্বারা উদ্ধৃত। আসলে জ্ঞান বা সৃষ্টির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণাটাই এসেছে অনেক পরে। একটা যুগ পর্যন্ত উদ্ধৃতি ব্যাপারটাকে এ রকম ঘোমটা-টোমটা পরিয়ে সন্তর্পণে ব্যবহার করার অভ্যেসই ছিল না, এক জন আর এক জনের কথা অকাতরে নিজের মুখে বসিয়ে নিত। লেখালিখিতেও আজকের মতো এমন আত্মপর ভেদ ছিল না। এমনকী কবিতায় গল্পে নাটকে কার কথা যে কখন কে নিজের করে নিত, তার হিসেব নেই। একেবারে হিসেব নেই, এমন কথা অবশ্য বলা যাবে না। একটি হিসেব: ‘হেনরি দ্য সিক্সথ’ নাটকের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অংশের ৬০৩৩ লাইনের মধ্যে ৪১৪৪ লাইন শেক্সপিয়রের সম্পূর্ণ মৌলিক সৃষ্টি নয়, হয় সরাসরি মেরে দেওয়া, বা ঈষৎ বদলে নেওয়া। এ বঙ্গের এক মহানায়কের কথা ঈষৎ বদলে নিয়ে
অস্কার ওয়াইল্ড
বলতে পারি, এ রকম তো কতই
ভার্জিনিয়া উলফ
হয়েছে! এক মার্কিন পণ্ডিত, অ্যান ফ্যাডিম্যান, অনেক গবেষণার শেষে সাব্যস্ত করেছিলেন, কারও লেখাতেই সত্যিকারের নতুন কথা খুঁজে পাওয়া ভারী কঠিন। এই নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলেন অ্যান: নাথিং নিউ আন্ডার দ্য সান।
শেক্সপিয়রের চেয়ে বয়েসে বছর তিরিশ বড়, ফরাসি পণ্ডিত মিশেল দ্য মঁতেইন তাঁর অজস্র প্রবন্ধে ধ্রুপদী গ্রিক এবং রোমান তাত্ত্বিকদের লেখা থেকে কত কথা যে তুলে নিয়েছেন কখনও ঋণ স্বীকার করে, কখনও বেমালুম। ঋণ ‘গোপন’ করার পিছনে তাঁর নাকি একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল: তাঁর সমালোচকরা যখন তাঁর কথা ভেবে আরিস্ততল বা সেনেকা-র কোনও অভিমতকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন, তখন তিনি মনে মনে উচ্চাঙ্গের হাসি হাসতেন। তা, আমাদের তো অত সংযম নেই, অতটা আত্মপ্রত্যয়ও নেই, নিজের মনে হেসে আমাদের মন ভরে না, তাই আমরা কথায় কথায় মনীষীদের কোটেশন লাগিয়ে দিই, মানে সেগুলো হল আমাদের পক্ষে একাধারে ঢাল এবং তরোয়াল। আর তাই বোধ করি রবীন্দ্রনাথ বাঙালির এত প্রিয়, তিনি যে কোনও বিষয়ে যে কোনও মতের সমর্থনে কাজে লাগেন। আমাদের নেতা খুব বড় রকমের গোলমাল পাকালেও আমরা ধৈর্য ধরে থাকি, কারণ মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। ওদের নেতা ছোটখাটো দোষ করলেও আমরা রে রে করে তেড়ে যাই, কারণ অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে ইত্যাদি। একটা কথা মানতেই হবে, দুরাত্মার কোটেশনের অভাব হয় না।
সত্যিকারের দুরাত্মারা অবশ্য উল্টোরথের সারথি। তাঁরা অন্যের কথা নিজের মুখে বসান না, নিজের কথা নামকরা কারও মুখে বসিয়ে দেন। এবং ক্রমশ সে সব কথা উদ্ধৃতি হিসেবে চালুও হয়ে যায়। এমন ‘মিসকোটেশন’ যে বাজারে কত চলে আসছে, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। গাঁধীজিকে বিলেতের এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে আপনার কী মত? গাঁধীজির উত্তর ছিল: ব্যাপারটা হলে ভালই হয়। (‘আই থিঙ্ক ইট উড বি আ গুড আইডিয়া।’) কত বার কত উপলক্ষে উদ্ধৃতিটি পড়েছি এবং সগর্বে ভেবেছি, ব্রিটিশ হিউমার দিয়ে ব্রিটিশদের মুখের মতো জবাব দেওয়া বটে! অথচ, আসলে ঠিক এই কথাটি এই ভাবে তিনি কখনও বলেননি। অন্তত, বলেছেন যে, তার কোনও প্রমাণ নেই।
সুতরাং, কোটেশন দিতে হলে সাবধানে দেওয়াই ভাল।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.