পুস্তক পরিচয় ১...
কৃষ্ণকৌতুকে ভরা রোগসাহিত্য
কর্কটসহবাস, অজয় গুপ্ত। থীমা, ১৩০.০০
মাঝে-মধ্যে কিছু ব্যতিক্রমী সংবাদের কথা বাদ দিলে সরকারি হাসপাতালে পরিষেবার সুনাম বড় একটা শোনা যায় না। সে দিক থেকে বর্ষীয়ান লেখক অজয় গুপ্তর কর্কটসহবাস গ্রন্থটি ব্যতিক্রমী হিসেবেই বিবেচিত হবে। ব্যতিক্রমের অবশ্য আরও জোরাল কারণ আছে। ক্যানসার চিকিৎসার সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতার বর্ণনা ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষায় বেশ কিছু আছে বটে, কিন্তু বাংলা ভাষায় তা সত্যিই দুর্লভ। ক্যানসার নামে একটি ক্ষীণকায় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল গত শতকের আশির দশকের প্রথম দিকে। লেখিকা প্রয়াত তপতী মুখোপাধ্যায়। তার ছত্রে ছত্রে ছিল স্তন ক্যানসার নিয়ে তাঁর যন্ত্রণাকাতর অভিজ্ঞতা, মর্মবেদনা, বিরক্তি, বিষাদ ও হাহাকার। প্রায় তিরিশ বছরের ব্যবধানে অজয় গুপ্তর গ্রন্থটি পড়লে মনে হয় ক্যানসার নিয়ে মর্মবেদনা আর বিরক্তির দিন নিরসন হয়নি। চিকিৎসার ধরন-ধারণ কিছু বদলেছে বটে, তবে ভুক্তভোগীর অবস্থান বড় একটা পাল্টায়নি। তা সত্ত্বেও যা সবচেয়ে চোখে বেশি পড়ে, তা হল, রোগ নিয়ে হাহাকার এই গ্রন্থে প্রায় নিরুদ্দেশ। গ্রন্থের নামকরণেই তা স্পষ্ট।
বইটি পড়তে পড়তে মনে হবে— নিজেকে এবং নিজের ভোগান্তি নিয়ে পদে পদে নির্মল কৌতুকের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত বিষাদ আর বিড়ম্বনা। কৌতুক শুধু রোগভোগ নিয়েই না, বাল্যস্মৃতি, আশপাশের মানুষজন এবং দৈনন্দিনতা নিয়েও তা সমান সচল। হাসপাতালের আউটডোরে অপেক্ষমান থাকতে থাকতে তাঁর মনে হয়, শ্রীরাধিকাও বুঝি এমন ভাবেই প্রহর গুনতেন ‘বংশীধারী বনমালির বাঁশির সুরের প্রতীক্ষায়’। পুরনো, পরিচিত পাড়ায় হাঁটতে হাঁটতে তাঁর স্বগতোক্তি, ‘ভুল বানানে আজীবন কাটিয়ে ‘উজ্জলা’ সিনেমা অবশেষে পাণিনির অভিশাপে আপাতত প্রমোটারের হস্তগত।’ অপারেশনের পর যখন ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছেন, তখন তাঁর মন্তব্য, ‘সবার মুখে এক কথা: দিব্যি ভালো আছেন/আছ/আছিস। সবচেয়ে মারাত্মক হল, আমি নিজেই সেটা বুঝতে পারছি।’ আবার কেমোথেরাপির একঘেয়েমি বোঝাতে গিয়ে বলেন, ‘বর্তমান নারী সমাজের ভুরু আলাদা করে বর্ণনা করার যেমন কোনো মানে হয় না।’ এমন অনেক নিরাকুল, সরস, অনিবার্য মন্তব্য পাঠক বহুকাল মনে রাখবেন। শুধু রসিকতাই না, রোগটি যথাযথ ভাবে নির্ণীত হওয়ার পর যখন তিনি বলেন, ‘আশঙ্কা সত্যি হবারও তো একটা আত্মতৃপ্তি আছে,’ তখন মনে হয় অনাবিল ‘কৃষ্ণকৌতুকের’ আবহে এ এক অনবদ্য ‘রোগসাহিত্য’ই বটে। এমন রসোত্তীর্ণ রচনায় যখন এক জন প্রাজ্ঞের নিষ্কপট, মানবদরদী মনটিও উন্মোচিত হয়, তখন মনে হয় যেন প্রাপ্যের চেয়ে একটু বেশিই পেলাম।
ধন্দ জাগে, যখন তিনি কৌতুকময় অভিজ্ঞতা ছেড়ে অন্য পথে পাড়ি দেন। সংশয়, স্ববিরোধিতা এবং নানান সংগত প্রশ্ন তখন পাঠকের মনে ভিড় করতে পারে। যথেষ্ট সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও, অন্যদের ‘বঞ্চিত’ করে বিচিত্র ‘কলকাঠি’ নাড়িয়ে তিনি যে সরকারি হাসপাতালে অতি দ্রুত একটি পেয়িং বেড সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন, সে কথা তিনি নিজেই নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন এই, এমন সিদ্ধান্ত তিনি নিতে গেলেন কেন? নানান কথার ফাঁদে উত্তরটি আটকা পড়ে গেছে। তাঁর দাবি, সরকারি হাসপাতালে এসে তিনি বৃহত্তর ভারতের ‘কাতর ও বিষণ্ণ মুখচ্ছবি’ দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু বৃহত্তর ভারতের যে জনমানুষ দৈনিক কুড়ি টাকার বেশি ব্যয়ের ক্ষমতাই রাখেন না, তাঁরা কি আদৌ হাসপাতালে এসে আধুনিক ক্যানসার চিকিৎসার সুযোগ নিতে পারেন? তিনি কি সত্যিই সেই মানুষজনকে দেখতে পেয়েছেন? অন্তত যাঁদেরকে দেখা সম্ভব ছিল, তাঁদেরকেও কি দেখতে পেরেছেন? তাঁর নিজের ভাষায়, ‘পারতপক্ষে’ তিনি ওয়ার্ডের ভেতরে তাকাতেন না। তা হলে? তা সত্ত্বেও যতটুকু অভিজ্ঞতা অর্জিত হল— ধরা যাক, সরকারি হাসপাতালে পরিষেবার বিচিত্র সমস্যা, তা কি তাঁর ছিল না?
তা ছাড়া, কেন যে তিনি ধরে নিলেন আমাদের দেশের ‘আনপাড়’ জনমানুষ মোটেই সচেতন না, সে আরেক ধন্দ। তাই তিনি উদ্বিগ্ন, কী ভাবে সেই চিকিৎসিত, নির্জীব, ক্ষত-বিক্ষত মানুষজন গৌতম বুদ্ধের শাশ্বত বাণীটিকে সার্থক করে তুলবেন,— ‘আত্মদীপো ভব’; কী ভাবে তিনি বোঝাবেন, ‘হেরে যাবার জন্য মানুষের জন্ম হয় না।’ যেন হতদরিদ্র বা অসংস্কৃত বলেই তাঁদের এক-আধ জন গুরু দরকার। অথচ সচেতনতার চূড়ান্ত অভাব যে বরং শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেশি, তা তো তিনি জানেন। আসলে সচেতনতার সংজ্ঞা যে কী, তা নিয়েই ধন্দ। নির্ধন পাবলিককে নিয়ে মননশীল বোদ্ধাদের মধ্যে এমন মোহজাল অবশ্য নতুন কিছু না। তবে তাঁর মতো এক জন বরিষ্ঠ, স্থিতধী, সত্যানুসন্ধানীর কাছ থেকে এমন দিগ্ভ্রান্ত উদ্বেগ প্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু কী করা? তিনি যে যুদ্ধের বাতাবরণে, সমরাস্ত্রের ঝংকারেই ক্যানসার সমস্যাকে বুঝতে চেয়েছেন।
তাই গ্রন্থের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ক্যানসারকে বিচিত্র বিশেষণে অভিহিত করতে করতে, এমনকী পুনরুক্তি করেও তাঁর স্বস্তি হয় না। কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামের মতো ক্যানসারও যে অমন অজস্র মেটাফর-এ বহুকাল যাবৎ অভিষিক্ত, তা তো সুজান জোন্ট্যাগ-এর লেখা থেকেই জানা যায়; বা ইদানীং কালে রিচার্ড পেনসন-এর প্রবন্ধেও। সমস্যা এই যে ‘গুপ্তঘাতক’, ‘প্রকৃতিনিয়োজিত সুপারি-কিলার’, ‘খতরনাক আততায়ী’, ‘ঘৃণ্য কাপুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বী’ ইত্যাদি কোনও বিশেষণই ক্যানসারের জীববিদ্যার সঙ্গে মানানসই না। সমস্যা এও যে, ক্যানসারকে সৃষ্টিছাড়া, পাশবিক, মাওবাদী বলে ডাকলেও সে তাঁরই রক্ত, তাঁরই মাংস, তাঁরই কোষপুঞ্জ থেকে তৈরি, তাঁরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। সে কোনও বিদেহী, বিদেশি শত্রু না যে তাকে প্রচলিত অর্থে ‘প্রতিরোধ’ করা যাবে অথবা প্রতিশোধের আগুনে পুড়িয়ে ফেলা যাবে। সে আমাদের অপছন্দের বটে, কিন্তু কী করা,— প্রকৃতি যে আমাদের শরীরে কেবল আমাদের পছন্দের ডালি সাজিয়ে রাখে না। লেখকও তা জানেন, শুধু মানতেই যা সমস্যা। অথচ এও তো সত্যি যে, তিনি নিজের অজান্তেই বহুকাল নির্বিঘ্নে, নিরাপদে তাঁর কর্কটের সঙ্গে সহবাস করেছেন,— জনৈক শল্যবিদের মতে তা ‘বছর দশেকের কম নয়’। এই উপলব্ধিটুকু তাঁর কাছে প্রত্যাশিত ছিল।
কারণ, লেখকের সজাগ মনের পরিচয় এই গ্রন্থেই আছে। যেমন, রোগটিকে ‘আগেটাগে’ ধরে ফেলা বলে কিছু নেই, ক্যানসার চিকিৎসায় এখন ‘ওষুধ-বাণিজ্যের সাম্রাজ্য’ বিস্তৃত, ‘এই রোগ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার যে-সব উপায়... সবগুলোই অসত্য অর্ধসত্য অথবা অর্থহীন’ ইত্যাদি অব্যর্থ মন্তব্যই তার প্রমাণ। তেমনই কিছু মন্তব্য যথেষ্ট বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, ‘ক্যানসার আমাদের দেশে, এখনও, চিকিৎসাশাস্ত্রগত কোনও সমস্যাই নয়। এটা পুরোপুরি, সর্বাংশে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা’, ‘তৈরি হোক কম দামের ওষুধ। ওটাই ক্যানসারের আনসার’, ‘আমার প্রাইভেট মিনি ভারতবর্ষের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মৃত্যুহার যে তুলনামূলকভাবে কম, তার কারণ শুধু অর্থবল নয়, লোকবলও’ ইত্যাদি। অথচ মনোযোগী পাঠক মাত্রেই জানেন যে, ক্যানসার যদি একটি সমস্যাই হয়, তবে তা জৈবিক, অন্য কিছু না। এও তাঁদের জানা যে, ধনবানদের মধ্যে ক্যানসার-জনিত মৃত্যুহার মোটেই কম না। আর অর্থ বা গণ-উদ্যোগের ভরসায় মৃত্যুহার কমানোও যায় না। মনে পড়ে, বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক হেনরি লুই মেনকেন একবার বলেছিলেন, ‘জটিল সমস্যাগুলোর সরল, সহজবোধ্য সমাধান থাকে ঠিকই, তবে সেগুলো ভুল।’
মনে হয় এ সবই তাঁর কর্কটসহবাস-জনিত বিপন্নতারই বহিঃপ্রকাশ। তাই প্রকৃতির নিয়ম নিয়ে তাঁর সংশয় নেই বটে,— তিনি নিজেই বলেন, ‘মৃত্যু ধ্রুব। ওটা সৃষ্টির শর্ত।’ অথচ সৃষ্টির যে আরও কিছু শর্ত থাকে, অনাসৃষ্টিও যে সৃষ্টিরই শর্ত, তা নিয়েই তাঁর বিরোধ। তিনি ‘সারা জীবন নিজেকে নীরোগ সুস্থদেহী স্বাস্থ্যবান-রূপে কল্পনা’ করে এসেছেন। কিন্তু কল্পনা কেন? তিনি তো স্বাস্থ্যবানই। রোগভোগ তো অস্বাস্থ্যের লক্ষণ না; বরং রোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠাই স্বাস্থ্যের লক্ষণ। এমন এক জন স্বাস্থ্যবান সুলেখকের ঈর্ষণীয়, সরস কলমের কাছ থেকে বাংলা গদ্য সাহিত্যের আরও কিছু প্রাপ্য আছে।
সামান্য কিছু মুদ্রণপ্রমাদ সত্ত্বেও ক্যানসারের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা নিয়ে এমন একটি সুখপাঠ্য রচনার জন্য লেখকের কাছে বাঙালি পাঠকসমাজ বহুকাল ঋণী হয়ে থাকবেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.