কেন্দ্রীয় সরকারের অন্দরমহলের ছবিটা যে মোটেও সুখের নয়, আরও এক বার সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ারের ক্ষোভপ্রকাশে। গত কাল মনমোহনকে লেখা চিঠিতে পওয়ার অভিযোগ করেন, শরিক হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছেন না তাঁরা। বলেছেন, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সমস্ত বিষয়েই একতরফা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কংগ্রেস। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, কর্মীদের চাপে দলীয় সংগঠনে মন দিতে তাঁরা মন্ত্রিসভা থেকে সরে এসে বাইরে থেকে সমর্থনের কথা ভাবছেন। এই চিঠিতে অশনি সঙ্কেত দেখে কাল থেকেই পওয়ারকে বুঝিয়ে ক্ষোভ সামলাতে তৎপর হয়েছেন সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহ দু’জনেই।
এত দিন কংগ্রেসের দিকে গুরুত্ব না দেওয়ার অভিযোগ তুলত তৃণমূল। এ বার পওয়ারও একই অভিযোগ তুললেন। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে গত কালই পওয়ারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন মনমোহন ও সনিয়া। আজ সকালে এনসিপি প্রধানের সঙ্গে বৈঠকও করেন সনিয়া। প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি দেন, “পওয়ার আমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ সহকর্মী। তাঁর বিবেচনা, বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা আমাদের সরকারের সম্পদ।” কংগ্রেসের কোর গ্রুপেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। পওয়ারের ক্ষোভ মেটাতে তাঁকে খরা বিষয়ক বিশেষ মন্ত্রিগোষ্ঠীর প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে ঠিক হয়েছে। সে ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্রে খরা পীড়িতদের জন্য বিশেষ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের রাজ্যে রাজনৈতিক ফসল তুলতে পারবেন পওয়ার। কংগ্রেসের তরফে আশা, এর পরে হয়তো সমস্যা মিটবে। যদিও আজ মন্ত্রকে না গিয়ে মহারাষ্ট্রে ফিরে গিয়েছেন পওয়ার ও প্রফুল্ল পটেল। জানিয়েছেন, সোমবার সিদ্ধান্ত জানাবেন। তবে কংগ্রেসের একটি সূত্রের দাবি, কাল সনিয়াকে দেওয়া চিঠিতে কিন্তু পওয়ার ইউপিএ-র সঙ্গে থাকার কথাই বলেছেন। এর থেকে মনে হয়, জোট ছাড়ার ইচ্ছে নেই তাঁর। মহারাষ্ট্রে সেচ ও পূর্ত বিভাগে তাঁর দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ। তা থেকে বাঁচতেই এই পাল্টা চাপ সৃষ্টি করছেন পওয়ার। |
একটি রাজনৈতিক সূত্রের অবশ্য বক্তব্য, কেন্দ্রে সরকার পরিচালনার ধরন নিয়ে অনেক দিন ধরেই পওয়ারের মনে ক্ষোভ জমছিল। কৃষকদের জন্য খাদ্যশস্যের সহায়ক মূল্য বাড়ানো, তুলো বা চিনি রফতানির মতো নানা বিষয়ে তাঁর দাবিতে কর্ণপাত করা হয়নি। রাজ্যপাল বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে নিয়োগ নিয়েও তাঁর মতামত নেওয়া হয় না। এই ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় মন্ত্রিসভায় দু’নম্বর পদ নিয়ে বিতর্ক। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বিদায়ের পর মন্ত্রিসভায় তাঁকেই দু’নম্বর ব্যক্তির মর্যাদা দেওয়া হোক, পওয়ার এমনটাই চাইছিলেন। কিন্তু মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী পাশে প্রণবের শূন্য আসনে এ কে অ্যান্টনিকে বসতে দেওয়া হয়। সরকারি ভাবে অবশ্য যুক্তি দেওয়া হয়, মন্ত্রিসভায় দু’নম্বর ব্যক্তির বিষয়টা একটা ধারণা। এমন কোনও পদ নেই। এনসিপি নেতা প্রফুল্ল পটেলের দাবি, “শরদ পওয়ার কোনও দিনই মন্ত্রিসভার দুই নম্বর পদ নিয়ে চিন্তিত নন। এত ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সাধারণ ব্যক্তি তিনি নন।” একই সঙ্গে মন্ত্রিসভা
থেকে পওয়ার বা তাঁর পদত্যাগের জল্পনাও খারিজ করে দিয়েছেন পটেল।
তা হলে কেন হঠাৎ ক্ষোভ প্রকাশ করছেন পওয়ার? এনসিপি সূত্রের খবর, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আর দেরি নেই। একই বছরে মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচন। এই অবস্থায় মুলায়ম, মমতা, নীতীশ কুমাররা কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘাতে যাচ্ছেন। আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে নতুন জোটের সম্ভাবনাও ভেসে উঠছে। পওয়ারও মনে করছেন, ইউপিএ-র জনপ্রিয়তা যখন কমছে, তখন কংগ্রেস-বিরোধিতার আবহটাকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। তাতে সরকার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা খোলা থাকবে। তাই কেন্দ্রে চাপ বাড়াতেই চিঠি। আজ দফতরেও যাননি তিনি বা প্রফুল্ল পটেল। আবার রাজ্যে দলের নেতা-কর্মীদের এ ভাবে বার্তা দিলেন, কংগ্রেসকে এক চুল জমি ছাড়া হচ্ছে না।
কংগ্রেস নেতারা আবার বলছেন, আসলে কেন্দ্রকে চাপ দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করে নিতে চাইছেন পওয়ার। সে জন্যই নিজের রাজ্যের কৃষকদের মন জয় করতে কৃষিজাত পণ্যের সহায়ক মূল্য বাড়ানোর দাবি তুলছেন বা তুলো ও চিনি রফতানির ছাড়পত্র দিতে বলছেন। আবার মহারাষ্ট্রের খরা সমস্যার সমাধানে রাজ্য সরকারকে আরও সক্রিয় হতে বলছেন। সব দিক বিবেচনা করেই তাঁকে খরা বিষয়ক মন্ত্রিগোষ্ঠীর প্রধানের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মনমোহন। |
পওয়ার আমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ সহকর্মী। তাঁর বিবেচনা, বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা আমাদের সরকারের সম্পদ।
মনমোহন সিংহ |
|
পওয়ারের অন্য দাবিগুলিকে অবশ্য গুরুত্ব দিতে নারাজ কংগ্রেস। প্রফুল্ল পটেল দাবি করেছেন, ইউপিএ-র মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি কমিটি তৈরি করা হোক। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, তৃণমূলও দীর্ঘদিন ধরে এই দাবি করে আসছে। কংগ্রেস নেতারা কিন্তু দাবি খারিজ করে দিয়ে বলছেন, ইউপিএ-র প্রথম জামানায় বামেরা বাইরে থেকে সমর্থন করতেন বলেই সমন্বয় কমিটি ছিল। যাঁরা সরকারে রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য আলাদা করে কমিটির কী দরকার!
এনসিপি-র নেতাদের যুক্তি, তাঁরা সব সময়ই ইউপিএ-র সব থেকে দায়িত্বশীল শরিকের ভূমিকা পালন করেছেন। অন্যদের মতো পেট্রোলের দাম বা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে রাস্তায় নামেননি। বলা বহুল্য, এনসিপি-র ইঙ্গিত তৃণমূলের দিকে। কংগ্রেস নেতারাও জানেন, মমতা যে আবেগে ভর করে ‘জনবিরোধী’ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন, পওয়ার তা করেন না। তাঁর সিদ্ধান্তের পিছনে রাজনৈতিক স্বার্থ থাকে। কেন্দ্র ও রাজ্যে এনসিপি-র নেতাদের বিরুদ্ধে নানা রকমের দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। কংগ্রেস নেতারা মনে করছেন, মহারাষ্ট্রে যে ২৬ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে, তাতেই খাপ্পা পওয়ার। আর দুর্নীতির অভিযোগ আছে বলেই তৃণমূলের তুলনায় এনসিপি-কে নিয়ন্ত্রণে রাখাও সহজ। পওয়ার নিজেও এত তাড়াতাড়ি মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেবেন না। তা হলে সব দিক থেকেই তাঁর বিপদ বাড়তে পারে। |