|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
একাকীর অনুভবেই অর্জন করেছেন স্বতন্ত্র শিল্পদৃষ্টি |
সম্প্রতি আকার-প্রকারে অনুষ্ঠিত হল বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের একক প্রদর্শনী। ঘুরে এলেন মৃণাল ঘোষ। |
সম্প্রতি আকার-প্রকার গ্যালারিতে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ছোট ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল। পরিকল্পনা করেছেন দেবদত্ত গুপ্ত। ২০০৪-এ শিল্পীর জন্মশতবার্ষিকীর পরে ২০০৬-০৭-এ দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর সারা জীবনের কাজ নিয়ে বড় মাপের প্রদর্শনী। সেই মাত্রায় কলকাতায় কিছু হয়নি। আলোচ্য প্রদর্শনীটি সেই অভাব খানিকটা পূর্ণ করল। ছোট কাজ হলেও শিল্পীর ব্যক্তিত্বের নানা দিক অনুধাবন করা যায় এই ছবি থেকে।
আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলায় বিনোদবিহারী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী। তরুণ বয়স থেকেই তিনি দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। কিন্তু নব্য-ভারতীয় ঘরানার যে জাতীয়তাবাদী চিত্রকলা, তার সঙ্গে কখনও একাত্ম হতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব তাঁকে এক নতুন আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিনোদবিহারী বলেছেন, ‘তিনি (রবীন্দ্রনাথ) আমায় লিখেছিলেন, সে চিঠি আছে, যে তুমি যদি নন্দলালকে ছেড়ে না দাও, তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে। প্রায় অভিসম্পাত!’ তাই শান্তিনিকেতনে নন্দলালের ছত্রছায়ায় থেকেও তিনি তথাকথিত ভারতীয় ধারার বাইরে স্বতন্ত্র এক শিল্পাদর্শ গড়ে তুলেছিলেন। প্রাচ্য দর্শনচেতনা থেকে বিনোদবিহারী গড়ে তুলেছেন ভারতীয় আধুনিকতার বিশেষ এক অভিজ্ঞান, যেখানে তিনি জাতীয় আত্মপরিচয়কে প্রসারিত করেছেন বিশ্বগত মাত্রায়। তাঁর মধ্যে ছিল নিমগ্ন এক নির্জনতার বোধ। শৈশব থেকে অসুস্থতা, ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি, গৃহবন্দি হয়ে থাকা, স্কুলে যেতে না পারা এ সমস্তই তাঁকে অন্তর্মুখী করেছিল, তাঁর ভিতর একাকিত্বের অনুভব জাগিয়েছিল। এই নির্জনতার বোধ থেকে তিনি অর্জন করেছেন স্বতন্ত্র শিল্পদৃষ্টি। ক্ষীণ-দৃষ্টি ও শেষ জীবনের দৃষ্টিহীনতা তাঁকে দিয়েছিল এক অন্তর্দৃষ্টি। এই দুইয়ের সমন্বয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব শিল্পের জগৎ। বাইরের সমস্ত সংঘাত ও কালিমাকে আত্মস্থ করে উন্মীলিত করেছেন সংবৃত এক সৌন্দর্যের রূপকল্প। বৈশ্বিক সচেতনতা নিয়ে প্রাচ্য দর্শন সেখানে তাঁর প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছে। এ জন্য তিনি তাঁর আঙ্গিকের প্রধান এক নির্ভর করে তুলেছেন ক্যালিগ্রাফিকে। সেখানে চিন ও জাপানের ঐতিহ্য তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে। |
|
শিল্পী: বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় |
এই প্রদর্শনীতে আমরা যে সব ছবি দেখি, তার অধিকাংশতেই রেখারূপের প্রাধান্য। ক্যালিগ্রাফি বা লিখনরীতি তার একটি বিশেষ মাত্রা। প্রদর্শিত চিত্রাবলিকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। প্রধানত প্রকরণের দিক থেকে। যেমন, কালি-তুলি, ক্যালিগ্রাফি, কালি-কলমের নিসর্গ, কালি-কলমের অবয়বী রচনা, ছাপচিত্র ও অন্যান্য মাধ্যম।
প্রথম পর্যায়ের কালি-তুলির ছবিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিভিন্ন মানুষকে লেখা তাঁর কিছু পোস্টকার্ড। এক পাশে ছবি এঁকেছেন। অন্য পাশে রয়েছে চিঠি ও প্রাপকের ঠিকানা। অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিজয়ার নমস্কার জানিয়ে একটি চিঠি লিখছেন ১৯২১ সালে। পোস্টকার্ডের উল্টো দিকটি সমতল ভাবে সম্পূর্ণ কালো কালিতে ঢেকে দিয়েছেন। ‘মিনিমাল’ বিমূর্ততার একটি দৃষ্টান্ত কি বলা যায় এই ছবিকে? ‘ক্যালিগ্রাফি’ পর্যায়ে কয়েকটি বইয়ের প্রচ্ছদ। যেমন ‘বিশ্বভারতী’ পত্রিকা বা অবনীন্দ্রনাথের ‘পথে বিপথে’। ‘বীণা বাজাও মম অন্তরে’ গানটির লিখনরূপে অক্ষরের স্পন্দন মুগ্ধ করে। কালি-কলমের নিসর্গগুলিতে শিল্পীর অন্তরের ধ্যান যেমন উন্মীলিত হয়, তেমনই পরিস্ফুট হয় বাংলা তথা শান্তিনিকেতনের প্রতি তাঁর ভালবাসা। বিশেষত একটি ছবি মর্মস্পর্শী। দিগন্ত-বিস্তৃত প্রান্তর। কয়েকটি রেখায় ধরেছেন শূন্য পরিসরের অসীম ব্যাপ্তিকে। তার মাঝখানে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে কয়েকটি তালগাছ। শূন্যতার মধ্যে অসীমের ধ্যানকে নিরন্তর জাগিয়ে রেখেছিলেন বিনোদবিহারী। তাঁর আলুলায়িত জড়ানো বক্ররেখার বিন্যাসের মধ্যে তাঁর নিজস্ব ক্যালিগ্রাফির ধরন কাজ করে। তাঁর সময়ের সমস্ত ভাঙনের বিপরীতে এই পূর্ণতার বোধ তিনি উপহার দিয়েছেন মানবজাতিকে।
কালি-কলমে করা মানব-অবয়বের রচনাগুলিতে দেখা যায় দুঃখজড়িত জীবনের মধ্যে আনন্দের নানা উদ্ভাস। অশোক মৈত্রকে লেখা একটি পোস্টকার্ডে নীল কালিতে এঁকেছেন পাখা হাতে উপবিষ্টা এক গ্রামীণ মানবীর আলেখ্য। আয়তনময়তায় অভিব্যক্ত করেছেন মানবীর অন্তরের ছায়াময় আলো। ছাপচিত্রগুলির মধ্যে একটি স্কেচ আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ছন্দিত সুরেলা রেখাবিন্যাসের জন্য।
বাঁক কাঁধে চলেছে এক গ্রামীণ ব্যাপারি। সংবৃত বা মিনিমাল এই রেখাবিন্যাসই এই শিল্পীর নিজস্ব ঘরানা। এটি আঁকার সময়ে তিনি ছিলেন দৃষ্টিহীন। কিন্তু বোঝা যায় তাঁর চৈতন্যের দৃষ্টি কত গভীরপ্রসারী। সামগ্রিক বিনোদবিহারী নেই এই প্রদর্শনীতে। তবু যা আছে, তার আলো আমাদের ঋদ্ধ করে। |
|
|
|
|
|