অবশেষে উৎপাদন শুরু হতে চলেছে বার্নপুরে ইস্কোর নতুন কারখানায়। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই।
আর এর হাত ধরেই ফের ‘তারুণ্যের দিকে’ নতুন উদ্যমে দৌড় শুরু করছে চুরানব্বই বছরের ইস্কো। চালু হলে, ১৯৯৪ সালে বিআইএফআরে চলে যাওয়া এই সংস্থা পুনরুজ্জীবিত হবে সেলের তৃতীয় বৃহত্তম কারখানা হিসেবে। খোলনলচে বদলে হয়ে উঠবে দেশে ইস্পাত শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তির অন্যতম পীঠস্থান। বছরে ২৫ লক্ষ টন ইস্পাত তৈরি হবে সেখানে।
ভারতে আধুনিক পদ্ধতিতে প্রথম পিগ আয়রন তৈরির কৃতিত্ব রয়েছে ইস্কোর ঝুলিতে। খোলামুখ ব্লাস্ট ফার্নেসও এ দেশে অন্যতম প্রথম ব্যবহার করেছিল তারা। এমনকী ১৮৭৫ ও ১৯০৪ সালে যথাক্রমে প্রথম লোহা এবং ইস্পাত তৈরি শুরু করা সংস্থা বেঙ্গল আয়রন ওয়ার্কস পরে মিশে গিয়েছিল ইস্কোর সঙ্গেই। অথচ পরে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকীকরণ করতে না-পারার কারণে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে গিয়েছিল তারা। এখন ‘ভুল শুধরে’ পুনরুজ্জীবনে তাদের তুরুপের তাস সেই উন্নত প্রযুক্তিই।
ইস্কোর সিইও নন্দকিশোর ঝা-র দাবি, “শুধু আকারের জন্য নয়। কারখানা নজর কাড়বে প্রযুক্তির কারণেও। এত কম জমিতে এত বড় কারখানা তৈরির নজির নেই বিশ্বে। আর তা করতে এখানে কারখানা গড়া হয়েছে তিনটি স্তরে। প্রথম থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের উচ্চতা যথাক্রমে ১৮ ও ৩০ মিটার বেশি। এখানকার ৪,০৬০ বর্গ মিটারের ব্লাস্ট ফার্নেস দেশের বৃহত্তম। উৎপাদন খরচ কমাতে বিদ্যুৎ ও বাষ্প ব্যবহারে প্রয়োগ করা হয়েছে উদ্ভাবনী চিন্তা।” তিনি বলেন, “সেকেন্ডে ১১৫ মিটার অয়্যার রড তৈরি হবে। দুনিয়ায় যার জুড়ি মেলা ভার।” নতুন কারখানা পুরোদস্তুর চালু হলে পুরনোটি গুটিয়ে নেওয়া হবে বলেও জানান ঝা। |
সংস্থার দাবি, নির্মাণে ব্যবহৃত অয়্যার-রড কারখানায় উৎপাদন শুরু হবে ডিসেম্বরের মধ্যে। ২০১৩-র মার্চের মধ্যে চালু হবে পুরো কারখানাই। প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ পাবেন ৫ হাজার জন। পরোক্ষ আরও ২০ হাজার। ব্যবসার সুযোগ তৈরি হবে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য। স্থানীয় মানুষের জন্য কিছু কল্যাণকর কর্মসূচি চালু করার কথাও জানিয়েছেন জেনারেল ম্যানেজার রাকেশ গুপ্ত।
এক সময় রাজ্যের গর্ব হিসেবে চিহ্নিত ইস্কো-র কারখানা ছিল দেশে তৃতীয় বৃহত্তম। বাঙালি শিল্পপতি বীরেন মুখোপাধ্যায় ডিরেক্টর থাকাকালীন বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা পৌঁছেছিল ১০ লক্ষ টনে। লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তা নথিভুক্ত ছিল ‘ব্লু চিপ’ সংস্থা হিসেবে। কিন্তু পরে লগ্নি ও আধুনিকীকরণের অভাবে রুগ্ণ হয়ে পড়া ইস্কো-কে ১৯৭২-এ অধিগ্রহণ করে কেন্দ্র। ১৯৭৯ সালে মালিকানা তুলে দেয় সেলের হাতে। তার পর অন্তত ১৩ বার ব্যর্থ হয়েছে তার আধুনিকীকরণ বা পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা। সেল বিক্রি করার চেষ্টা করলেও, সে সময় ইস্কো-কে কিনতে চায়নি জিন্দল স্টিল, মুকুন্দ আয়রন এবং রুশ সংস্থা তায়াজপ্রেন এক্সপোর্ট। তাই এই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া পরিস্থিতি থেকে এ ভাবে ঘুরে দাঁড়ানোকে ছাই থেকে উঠে আসা ফিনিক্স পাখির সঙ্গে তুলনা করছে শিল্পমহল।
ঝা-র বিশ্বাস, “সম্পূর্ণ উৎপাদন শুরুর বছর দুয়েক পরই মুনাফা করবে ইস্কো।” সংশ্লিষ্ট মহলও মনে করে, বিশ্বাস ভিত্তিহীন নয়। কারণ, সংস্থার হাতে আছে ৩টি লৌহ আকরিক খনি (গুয়া, চিরিয়া এবং মনোহরপুর)। চাসনালা, জিতপুর, রামনগরে আছে ৩টি কয়লাখনিও। তাই কাঁচামালের সুবিধা ইস্কোকে প্রতিযোগিতায় কিছুটা এগিয়ে রাখবে বলে তাঁদের অভিমত।
২০০৬-এ সেলের সঙ্গে পুরো মিশে যায় ইস্কো। বেরিয়ে আসে বিআইএফআর থেকে। ওই বছর ইস্কো পুনরুজ্জীবনে ৯,৫৯২ কোটি টাকার পরিকল্পনায় সায় দেয় সেল। নয়া কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। কিন্তু তা সত্ত্বেও দীর্ঘ ছ’বছর লেগে গিয়েছে কারখানা গড়তে। ঝা-র দাবি, “প্রতি পায়ে বাধা এসেছে। জমি না-পাওয়া দিয়ে সমস্যা শুরু। সাধারণত এ ধরনের কারখানায় ১,৪০০ একর জমি লাগে। এখানে করতে হয়েছে ৯৫৩ একরে। তা-ও প্রথমে খালি জমি ছিল মাত্র ৩৫৩ একর। বাকি জায়গায় পাহাড় হয়ে ছিল ৮০ বছর ধরে জমা ইস্পাতের বর্জ্য (স্লাগ)। আলগা জমি পোক্ত করতেও (পাইলিং) সময় গিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বাধা হয়েছে জমি নিয়ে স্থানীয় মানুষের আপত্তি। ফলে প্রকল্প এগোতে দেরি হয়েছে। বেড়েছে খরচও। পৌঁছেছে ১৬,৪০০ কোটি টাকায়।” |