বিস্ফোরণে কেঁপে উঠছে গ্রাম। দেওয়ালে ফাটল ধরছে। নামছে জলস্তরও।
বড়জোড়ার ট্রান্স দামোদর খোলামুখ কয়লা খনি নিয়ে এমনই অভিযোগে ক্ষুদ্ধ চুনপাড়া ও ভিড়কাশোল গ্রামের বাসিন্দারা। গত কয়েক মাস ধরে ভূগর্ভস্থ কয়লা তোলার জন্য খনির ভিতরে ডিনামাইট দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। এতে খনি লাগোয়া ওই দু’টি গ্রামে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ। কিন্তু বার বার দাবি জানিয়েও পুনবার্সন না হওয়ায় বাসিন্দাদের ক্ষোভ বাড়ছে। খনি কর্তৃপক্ষ অবশ্য তাঁদের পুনবার্সন দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
ঘুটগড়িয়া ও বড়জোড়া পঞ্চায়েতের বেশ কয়েকশো একর জায়গা নিয়ে খোলামুখ খনি তৈরি করার কাজে নেমেছে ওয়েস্টবেঙ্গল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড। বর্তমানে বাঁকুড়া-দুর্গাপুর ৯ নম্বর রাজ্য সড়ক লাগোয়া চুনপাড়া ও ভিড়কাশোল গ্রাম থেকে কয়েকশো মিটার দূরে মাটি খুঁড়ে কয়লা তোলার কাজ চলছে। কয়লা তোলার জন্য মাটির নীচে বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, বিস্ফোরণের তীব্রতায় ফাটল ধরেছে ঘরবাড়িতে। বিস্ফোরণের দাপটে বসবাস করা দায় হয়ে উঠেছে। চুনপাড়ার বাসিন্দা একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী রঞ্জিত ভুঁই কয়েক বছর আগে পাকা দেওয়ালের উপর অ্যাসবেস্টসের ছাউনির বাড়ি তৈরি করেছিলেন। তাঁর অভিযোগ, “অনেক কষ্টে বাড়ি তৈরি করেছিলাম। বিস্ফোরণের তীব্রতায় দেওয়াল ফেটে গিয়েছে। অ্যাসবেস্টস ফেটে বৃষ্টির জল পড়ছে। দেওয়াল চাপা পড়ার ভয়ে বাড়ির ভিতরে থাকতে ভয় করছে।” |
একইরকম আশঙ্কায় রয়েছেন ওই গ্রামের শঙ্কর ভুঁইয়ের পরিবার। তাঁর বাড়ির দেওয়াল, মেঝে, পাঁচিলে ফাটল দেখা দিয়েছে। তাঁর স্ত্রী সন্ধ্যা ভুঁইয়ের অভিযোগ, “প্রতিদিন দুপুরে বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। প্রচণ্ড শব্দে ঘরবাড়ি সব কাঁপতে থাকে। তাক থেকে জিনিসপত্র নীচে পড়ে যায়।” গ্রামের বধূ অনিতা মাঝি জানান, বিস্ফোরণের শব্দে অনেকের কানের সমস্যা হচ্ছে। কম্পনে ভয় পেয়ে অনেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁর স্বামী বুধন মাঝি বলেন, “এই গ্রামে এখন আর নিরাপদে বাস করার উপায় নেই। আমরা তাই পুনর্বাসন চাইছি।”
চুনপাড়া লাগোয়া ভিড়কাশোল গ্রামেও ছড়িয়েছে আতঙ্ক। ওই গ্রামের বাসিন্দা মন্টু ঘোষের পাকাবাড়ির দেওয়ালে দেখা গেল ফাটল ধরেছে। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, বিস্ফোরণের জেরে জলস্তরও নেমে গিয়েছে। ফলে গ্রামের নলকূপ গুলি থেকে আগের মতো আর জল ওঠে না। স্থানীয় বাসিন্দা বিনয়কুমার রায় বলেন, “গ্রামে কয়েকটি নলকূপ থাকলেও জল কম পড়ছে। জলস্তর নেমে গিয়েছে। এ বার গ্রীষ্মে জলের জন্য আমাদের চরম হয়রানি হয়েছে।”
চুনপাড়া ও ভিড়কাশোল গ্রামের বাসিন্দারা ‘ধর্মরাজ বাস্তুহারা ভূমিহারা কল্যান সমিতি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে আন্দোলন শুরু করেছেন। ওই সংগঠনের সভাপতি হরিপদ পাল বলেন, “আমাদের অন্যত্র পুনর্বাসন দেওয়া হবে বলে বছর দেড়েক ধরে খনি কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়ে আসছেন। কিন্তু আজও তা হল না।” এ নিয়ে একাধিক বার তাঁরা প্রশাসনের বিভিন্ন আধিকারিকের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, খনি কর্তৃপক্ষকে বিক্ষোভও দেখিয়েছেন। কিন্তু পুনবার্সন হয়নি। মাস খানেক আগে এই খনির উদ্বোধনে আসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছে তাঁরা স্মারকলিপিও দেন। মুখ্যমন্ত্রী জেলাশাসক মহম্মদ গুলাম আলি আনসারিকে সমস্যাটি দেখতে নির্দেশ দিয়ে যান। ওই সংগঠনের সম্পাদকের অভিযোগ, “মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিলেও জেলা প্রশাসনের কোনও কর্তাই আমাদের সমস্যার কথা জানতে ডাকেননি। এখন বর্ষায় দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত্যুর আশঙ্কায় আমরা কাঁটা হয়ে রয়েছি।”
এই দু’টি গ্রামে কমবেশি ৩৫০টি পরিবারের বাস। বড়জোড়ার তৃণমূল বিধায়ক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “ওই দু’টি গ্রাম আমি দেখেছি, বিস্ফোরণে কিছু বাড়ির ক্ষতি হয়েছে। তবে বাড়ি ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয়নি। তা সত্ত্বেও আমি খনি কর্তৃপক্ষকে বলেছি, দ্রুত তাঁদের পুনবার্সন দিতে হবে।” জেলাশাসকও বলেছেন, “পুরো পরিস্থিতির উপরে আমাদের নজর রয়েছে।’’ খনি কর্তৃপক্ষের তরফে কোলিয়ারির এজেন্ট অশোককুমার বিশ্বাস বলেন, “ওই দু’টি গ্রামের বাসিন্দাদের পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই বড়জোড়া সদরের কাছে ২৪ একর জমি কেনা হয়েছে। বর্ষা শেষ হলেই বাড়ি তৈরি করার কাজ শুরু করা হবে।” |