পরিসংখ্যান বলিবে, রাজেশ খন্না চার দশকের বেশি সময় মুম্বইয়ের হিন্দি ছবিতে অভিনয় করিয়াছেন। পরিসংখ্যান নামক শুষ্কং কাষ্ঠং পরিত্যাগ করিয়া জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের সরস তরুবরটিকে প্রশ্ন করিলে সে জানাইয়া দিবে, রাজেশ খন্নার অসামান্য সাফল্যের যুগটির মেয়াদ এক দশকেরও কম। তাহার পরেও তিনি কখনও কখনও কোনও কোনও ছবিতে সফল হইয়াছেন, কিন্তু তাহা ব্যতিক্রমী সাফল্য। মুম্বই চলচ্চিত্রের ‘প্রথম সুপারস্টার’ এক বিশেষ যুগের মহানায়ক। ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ এবং সত্তরের প্রথমার্ধ যুগটি বিশ্বের এবং ভারতের প্রচলিত ইতিহাসেও বিশেষ অনুষঙ্গে চিহ্নিত। স্বপ্নভঙ্গের অনুষঙ্গ, আবার নূতন স্বপ্নেরও। বিশ্বের কথা থাকুক, ভারতে তখন স্বাধীনতার স্মৃতি ম্লান হইয়া আসিতেছে, জাতীয় পতাকা ক্রমে বিবর্ণতর, দেশনায়কদের মহিমা বিলীয়মান, পণ্ডিত নেহরু এক সময় হতমান, অতঃপর গতায়ু। এই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়াইয়া সমাজের একটি অংশ নূতন স্বপ্ন দেখিয়াছিল, দেখাইতে চাহিয়াছিল। বিপ্লবের স্বপ্ন। তাহারও নায়ক ছিলেন। এক বা একাধিক নায়ক, চিনের চেয়ারম্যান সমেত। কিন্তু তাঁহারা পুরানো দেশনায়কদের স্থান লইতে পারেন নাই, সেই প্রশ্নও ছিল না। যুগটি কেবল স্বপ্নের প্রস্থানপর্বই ছিল না, মহানায়কেরও।
দেবতা না থাকিলে দেবতা নির্মাণ করিতে হয়। বাস্তব ভারতে মহানায়কের দিন শেষ হইল, সেলুলয়েডের ভারতে সুপারস্টারের আবির্ভাব ঘটিল। স্টার, তারকা, নায়ক, তাহার আগেও ছিলেন, তাঁহাদের জনপ্রিয়তাও ছিল বিপুল। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তা কখনওই গণ-উন্মাদনায় উচ্ছ্বসিত হয় নাই, দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে নায়কের মোহে অভিভূত হইয়াছেন এবং সিনেমা শেষ হইলে জীবনে ফিরিয়া আসিয়াছেন। রাজেশ খন্না প্রেক্ষাগৃহ এবং জীবনের মধ্যবর্তী প্রাচীর ভাঙিয়া দিলেন, সীমারেখা মুছিয়া দিলেন। মুগ্ধ দর্শক অভিভূত ভক্তে পরিণত হইলেন, সেলুলয়েডের মহানায়ক দেবতাপ্রতিম সুপারস্টারে। জাগরণে নায়ক নাই, স্বপ্নের নায়ক শূন্যস্থান পূরণ করিলেন। সেই নায়কের ব্যক্তিজীবনও অস্থির, অবিন্যস্ত, অশৃঙ্খল উচ্ছ্বাসের বেগে তাঁহার ভক্তদের মোহাবিষ্ট করিয়া তুলিল। তাঁহার গাড়িতে মুগ্ধ ওষ্ঠাধরের চিহ্ন আসলে বাস্তব এবং কল্পনার সেই সমাপতনের পরিণাম। তাঁহার আগে যে নায়করা ছিলেন, তাঁহারা কল্পনার ভুবনেই বিরাজমান থাকিতেন, তাঁহারা যেন পৃথিবীর কেহ নহেন, ইদানীং বেড়াইতে আসিয়াছেন। তাঁহারা বড় বেশি কল্পনার। তাঁহার পরে যে মহানায়ক আসিবেন, সেই ‘ক্রুদ্ধ যুবাপুরুষ’ ক্রোধের প্রতীক হইবেন লাঞ্ছিত, লুণ্ঠিত, রক্তাক্ত বাস্তব হইতে সঞ্জাত সেই ক্রোধের সর্বশক্তিমান আস্ফালন ও বিজয়ও কাল্পনিক, কিন্তু তাহার জন্ম ওই তমসাময় বাস্তবের গর্ভেই।
রাজেশ খন্নার মূর্তিতে যে মোহ, তাহা স্বয়ম্ভূ। তাঁহার স্বপ্নময়তা অবশ্যই অলীক, ভাবালু, পলায়নী, কিন্তু সেখানেই তাহার শক্তি। বিধ্বস্ত দর্শককুল সেই মোহেই আবিষ্ট হইয়াছিলেন। সেই আবেশ দীর্ঘস্থায়ী হয় নাই, হইতে পারে না। রাজেশ খন্নার সফল ছবির অভূতপূর্ব এবং অকল্পনীয় দৌড় এক দশকের মধ্যেই শেষ হইয়া যাইবে, ইহাই অনিবার্য এবং স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সেই ক্ষণ-তীব্র সাফল্যের স্মৃতি-শক্তি যে কতখানি প্রবল এবং সুদূরপ্রসারী, সেই সত্যটি জানাইয়া দিয়াই তিনি বিদায় লইলেন। এই বিদায় পূর্ণচ্ছেদ। এই সুপারস্টার বলিবেন না, ‘ছবি এখনও বাকি আছে বন্ধু।’ তিনি বলিবেন, ‘সময় শেষ, তল্পি গুটাইয়া লও।’ রাজেশ খন্না আর হইবে না। বঙ্কিম বলিতেন, আর হইবার প্রয়োজনও নাই। কিন্তু সুখস্বপ্ন ভুলিতে নাই। |