সরকার আইন বাঁধিয়া দিয়াছে এ যাবৎ যে বিদ্যালয়গুলি কেবলমাত্র উচ্চবর্গের আয়ত্ত ছিল, তাহাতে এখন সকলের সমান অধিকার। শিক্ষার অধিকার আইনে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিতে আর্থিক ভাবে পশ্চাদপদ শ্রেণির শিশুদের জন্য আসন সংরক্ষিত হইয়াছে। কিছু হতভাগ্য পিতামাতা ভাবিয়া বসিয়াছিলেন, সরকারি আইন যখন, সত্যই বুঝি তাঁহাদের সন্তানদের ওই অভিজাত বিদ্যালয়গুলির প্রবেশাধিকার জুটিয়াছে। দেশের অন্যান্য প্রান্তের ন্যায় বেঙ্গালুরুর একটি বেসরকারি বিদ্যালয়েও এমন কিছু ছেলেমেয়ে ঢুকিয়া পড়িয়াছিল। আইনে আটকায়, তাই কর্তৃপক্ষ তাহাদের মুখের উপর দরজা বন্ধ করিয়া দিতে পারে নাই, কিন্তু বিলক্ষণ একঘরে করিয়াছে। তাহারা শেষ সারিতে বসিতে বাধ্য হয়, বিদ্যালয়ের টাই-বেল্ট পায় না, শিক্ষকরা তাহাদের পড়া ধরেন না, বিদ্যালয় তাহাদের অভিভাবকদের আলোচনায় ডাকে না। তাহাতেও বুঝি কর্তৃপক্ষের আশ মেটে নাই প্রথম শ্রেণিতে যে কয়টি ‘অন্ত্যজ’ ছাত্রছাত্রী ছিল, কর্তৃপক্ষ তাহাদের চুল ছাঁটিয়া দিয়াছে। বোধ হয় চক্ষুলজ্জায় আটকাইয়াছে, নচেৎ, আশঙ্কা হয়, লোহা গরম করিয়া পাকাপাকি চিহ্নের ব্যবস্থা করা হইত। কাহারা এই উচ্চবর্গের বিদ্যালয়ে ‘অনধিকার প্রবেশ’ করিয়াছে, তাহা বেশ করিয়া দাগাইয়া দিয়া বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শান্ত হইয়াছে।
এই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্য কোনও শাস্তিই যথেষ্ট নহে। কিন্তু, তাহাদের শাস্তিবিধান হইলেই সমস্যা মিটিবে না। সমস্যাটির মূল অন্যত্র। ভারতীয় রাজনীতিকরা হঠাৎ উপলব্ধি করিয়াছিলেন, আর্থিক ভাবে অসচ্ছল শ্রেণির ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষার যথেষ্ট সুযোগ নাই। তাহাদের সুযোগ করিয়া দিতে আইন তৈরি হইল। স্থির হইল, সকল বিদ্যালয় এই অসচ্ছল শ্রেণির ছেলেমেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন সংরক্ষণ করিবে। সংরক্ষণ রাজনীতিকদের প্রিয় অস্ত্র, ব্যবহারে দ্বিধা নাই। অসচ্ছল শ্রেণির যত ছেলেমেয়ে পূর্বে পড়িবার সুযোগ পাইত, নূতন ব্যবস্থায় সেই সংখ্যা অনেক বাড়িবে। সুতরাং, সঙ্কীর্ণ অর্থে নীতি বলিতে যাহা বুঝায়, তাহার চশমায় দেখিলে এই ব্যবস্থাটি যথার্থ। কিন্তু, এই দেখার ধরনটি ঠুলি পরিয়া দেখিবার মতো। তাহাতে অধিকতর ছাত্রছাত্রী পড়িবার সুযোগ পীইতেছে, ইহা দেখা যায়, কিন্তু সেই সুযোগের সঙ্গে যে অসম্মান, যে লাঞ্ছনা অনিবার্য হইয়া উঠে, নীতি তাহা দেখিতে পায় না। জর্জ ডব্লিউ বুশ হয়তো বলিতেন, উহা বিদ্যালয়ে পড়িবার সুযোগের আনুষঙ্গিক ক্ষতি ‘কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ’।
এইখানেই বৃহত্তর ন্যায়ের গুরুত্ব। ন্যায়-বিচার বলিবে, এই লাঞ্ছনা, অসম্মান সম্পর্কেও সমান গুরুত্ব সহকারে ভাবিতে হইবে। কারণ, এই সমস্যাগুলি জন্মসূত্রে শিক্ষার সুযোগের সহিত এক নাড়িতে বাঁধা। যে আইন এই সুযোগ তৈরি করিয়াছে, সেই আইনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতেই এই অসম্মানের জন্ম। তাই, আইন বাঁধিবার সময় এই প্রতিক্রিয়া লইয়াও ভাবা উচিত ছিল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে গরিব ছেলেমেয়েদের পড়াইতে বাধ্য করা হইলে তাহারা যে বৈষম্যের মাধ্যমেই প্রত্যাঘাত করিবে, তাহা অনুমানের অতীত ছিল না। হয়তো সব বিদ্যালয় বেঙ্গালুরুর বিদ্যালয়টির ন্যায় প্রকট বৈষম্য করিবে না। কিন্তু, যে বৈষম্যকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, যাহার বর্ণনা হয় না, যাহাকে কেবল অনুভব করা যায়, তেমন চোরা বৈষম্য কার্যত অনিবার্য। আইন তাহাকে ঠেকাইবার ব্যবস্থা করে নাই। বোধ হয়, তেমন ব্যবস্থা করা আইনের সাধ্যাতীত। কিন্তু, এই বৈষম্য, অসম্মানের বিরুদ্ধে কোনও রক্ষাকবচ ছাড়াই এই শিশুদের অভিজাত বিদ্যালয়ের চক্রব্যূহে প্রবেশ করিতে বলা ন্যায়সঙ্গত নহে। অভিজ্ঞতা এই দরিদ্র অভিভাবকদের শিখাইবে আইন যাহাই বলুক, শিশুদের এই বিদ্যালয়ে পাঠাইয়ো না। তখন হয়তো নেতারা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিবেন, যাহারা সুযোগ গ্রহণ করিতে পারে না, তাহাদের উন্নতি করিবে কে? |