বৃহস্পতিবার বেলা প্রায় এগারোটা। দমদম স্টেশন ছেড়ে এক নম্বর লাইন দিয়ে ছুটছিল আপ শান্তিপুর লোকাল। হঠাৎই চালক দেখতে পান, সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা এক প্রৌঢ় এগিয়ে আসছেন লাইনের দিকে। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন হলুদ সিল্কের শাড়ি পরা এক মহিলা এবং জিনস পরা এক যুবক। ট্রেন তখন প্রায় ৯০ কিলোমিটার বেগে চলছে। তিনি প্রাণপণে হর্ন বাজিয়ে সতর্ক করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু, লাইন থেকে সরেননি ওই তিন জন।
পলকের মধ্যে তাঁদের ধাক্কা মেরে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় ট্রেন।
চালক সঙ্গে সঙ্গে খবর দেন কন্ট্রোল রুমে। সেখান থেকে খবর যায় দমদম জিআরপি-তে। পুলিশ জানিয়েছে, ট্রেনের চাকায় জড়িয়ে গিয়েছিল মহিলার দেহ। ট্রেনের ‘কাউ-ক্যাচার’-এ ধাক্কা খেয়ে ছিটকে লাইনের পাশে পড়েছিল অন্য দেহ দু’টি।
রেল সূত্রের খবর, কন্ট্রোল রুমে চালক যে প্রাথমিক রিপোর্ট দিয়েছিলেন তা থেকেই মনে হয়েছিল এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়। ছিন্নভিন্ন তিনটি দেহের পাশেই পড়েছিল প্লাস্টিকে মোড়া একটি চিঠি। সুইসাইড নোট। তা দেখেই পুলিশ
|
রজত পাল |
জানতে পারে মৃত তিন জন বাবা, মা এবং ছেলে। তাঁরা নিমতা থানা এলাকার উত্তর প্রতাপগড়ের বাসিন্দা।
ঠিক কী ছিল ওই সুইসাইড নোটে?
পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী চিঠির বয়ান হল, ‘আমি ব্রজদুলাল পাল, আমার স্ত্রী অনিতা পাল এবং আমার ছেলে রজত পালের বিরুদ্ধে বধূ নির্যাতনের মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। আমরা শেষ হয়ে গিয়েছি। বাড়ি থেকে পালিয়ে রয়েছি। এর পরেই পুলিশি খপ্পরে পড়ব। পুলিশের হাতে আরও নির্যাতিত হব। তা থেকে বাঁচতেই আমরা সবাই মিলে এই সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় ছিল না।’
পুলিশ জানায়, চিঠির শেষে মৃতদের ঠিকানা এবং একটি ফোন নম্বর লেখা ছিল। ওই নম্বরে ফোন করে পাওয়া যায় ব্রজদুলালবাবুর ভাই সত্যজিৎ পালকে। সত্যজিৎবাবু এসে মৃতদেহ তিনটি শনাক্ত করেন। শিয়ালদহের রেল পুলিশ সুপার উৎপলকুমার নস্কর বলেন, “প্রাথমিক তদন্তের পর জানা গিয়েছে, ওই তিন জন আত্মহত্যা করেছেন।”
ব্রজদুলালবাবুর লেখা ওই সুইসাইড নোটটির ভিত্তিতেই তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। তদন্তে জানা গিয়েছে, গত বছরের ৩ অগস্ট নিমতার গোলবাগানের বাসিন্দা এক তরুণীর সঙ্গে ব্রজদুলালবাবুর ছেলে রজতের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই রজত, তাঁর বাবা ও মা মিলে তাঁর উপর অত্যাচার করতেন বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন রজতের স্ত্রী। পুলিশ জেনেছে, ব্রজদুলালবাবুদের ছাপাখানার ব্যবসা রয়েছে। কিন্তু তা ভাল চলছিল না। ব্যবসায় অনেক টাকা ধার হয়ে গিয়েছিল পাল পরিবারের। |
এ দিন প্রতাপগড়ে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে বসে ওই তরুণী বলেন, “বিয়ের পর থেকেই নানা অছিলায় আমার উপরে অত্যাচার করতেন ওঁরা। মারধরও করতেন। অনেক সময় প্রতিবেশীরা এসে আমাকে বাঁচাতেন।”
তরুণীর মায়ের কথায়, “বহু লোকের কাছ থেকে অনেক টাকা ধার করেছিলেন ওঁরা। সেই ধার মেটানোর জন্য মেয়ের সোনার গয়নাগুলি চাইছিলেন। কিন্তু আমার মেয়ে তা দেয়নি। তাই নির্যাতন শুরু হয়।”
ওই তরুণীর বাবা-মা জানিয়েছেন, বাধ্য হয়ে গত ৩০ জুন তাঁরা মেয়েকে বাড়ি নিয়ে আসেন। ৯ জুলাই নিমতা থানায় একটি বধূ নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করা হয়।
ব্রজদুলালবাবুর প্রতিবেশীদেরও অভিযোগ, পালেদের বাড়িতে রোজই গোলমাল লেগে থাকত। বাড়ির বৌকে মারধরও করা হত বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। মাস খানেক আগে মেয়ের উপর অত্যাচারের বিষয়টি স্থানীয় এক তৃণমূল নেতাকে জানিয়েছিলেন তরুণীর বাবা। এ দিনের ঘটনার পর ওই তৃণমূল নেতা বলেন, “আমি মিটমাটের চেষ্টা করেছিলাম।”
পুলিশের মতো প্রতিবেশীদেরও ধারণা, ব্যবসায় প্রচুর ধার হয়ে যাওয়ায় ওই পরিবারটি মারাত্মক চাপের মধ্যে ছিল। বউয়ের গয়না বেচে সেই ধার শোধ করার কথা ভেবেছিলেন তাঁরা। সে রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানসিক অবসাদ চরমে ওঠে। তদন্তকারী পুলিশ অফিসারেরা জানিয়েছেন, সব দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। |