ফি-বছর নয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর অন্তর ছাত্র সংসদের নির্বাচন করার সুপারিশ করেছে উচ্চশিক্ষা সংসদ। কিন্তু এর ফলে ওই নির্বাচনকে ঘিরে হিংসা-হানাহানি বন্ধ হবে, এমন আশ্বাস দিতে পারেনি তারা।
মঙ্গলবার ওই সুপারিশ উচ্চশিক্ষা দফতরে জমা দেওয়া হয়েছে। এ বার উচ্চশিক্ষা দফতর আলোচনা করে ছাত্র নির্বাচনের চূড়ান্ত নিয়মবিধি তৈরি করবে। কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলির সঙ্গে এই ব্যাপারে কোনও আলোচনা না-হওয়ায় ওই সুপারিশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দলীয় রাজনীতির দাপাদাপি এ রাজ্যে দীর্ঘদিনের ‘ঐতিহ্য’। এবং রাজনৈতিক রেষারেষি অনেক ক্ষেত্রেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের চেহারা নেয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের অশান্তিতে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে লিংডো কমিশন ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে ২০০৬ সালে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুপারিশ করলেও এ রাজ্যে তা কখনওই কার্যকর হয়নি। বাম আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অভিন্ন নিয়ম তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছিল উচ্চশিক্ষা সংসদ। কিন্তু তা চূড়ান্ত হয়নি।
সম্প্রতি ছাত্রভোটকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু বলেজে অশান্তির পরে ওই নির্বাচনের অভিন্ন পদ্ধতি ঠিক করতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উচ্চশিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান সুগত মারজিৎকে নিয়ে ফের একটি কমিটি গড়া হয়। সেই কমিটির সুপারিশ, বিশেষ প্রয়োজন হলে পরপর দু’বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা যেতে পারে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া দু’বছরে এক বার নির্বাচন হোক। সুগতবাবু বুধবার বলেন, “নির্বাচনের একটা সবিস্তার প্রক্রিয়া আছে। দু’বছরে এক বার নির্বাচন হলে ফি-বছর সেই সমস্যা এড়ানো যাবে। আবার স্নাতক স্তরে যে-পড়ুয়া ভর্তি হচ্ছে, সে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দু’বার যোগ দেওয়ার সুযোগও পাবে।”
সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই এই সুপারিশের বিরোধিতা করেছে। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ মিত্র বলেন, “এঁরা কারও সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই সব ঠিক করে ফেলছেন! তার পরে সেগুলি কার্যকর করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছেন। প্রতি বছর এক দল ছাত্রছাত্রী বেরোচ্ছে আর এক দল ঢুকছে। তাদের মতামত আলাদা হতেই পারে।” তাঁর কথায়, তৃতীয় বর্ষের কোনও পড়ুয়া সংসদের দায়িত্বপূর্ণ পদ পেলে তিনি কলেজ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে পদটি এক বছর খালি থাকার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে, যা মোটেই কাম্য নয়।
তৃণমূল ছাত্র পরিষদ বা টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা অবশ্য জানান, সুপারিশের ব্যাপারে তাঁর কিছু জানা নেই। তাই এই বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি তিনি। তবে সংগঠনের অন্য এক নেতার কথায়, “উচ্চশিক্ষা সংসদ আমাদের সঙ্গে আলোচনা না-করেই এই সুপারিশ করেছে। আমরা চাই, কিছু ঠিক করার আগে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলা হোক।”
ছাত্র নির্বাচন সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য আরও কয়েকটি সুপারিশ করেছে সংসদ। যেমন, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ক্লাসে অন্তত ৭৫ শতাংশ উপস্থিতি থাকতেই হবে। লিংডো কমিশন এমনই সুপারিশ করেছিল। অনেকের ধারণা, এর জেরে নির্বাচনে লড়াইটা সীমাবদ্ধ থাকবে সত্যিকারের মনোযোগী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। আবার অন্য এক দলের ধারণা, এতে কলেজের হাজিরার খাতায় দেদার কারচুপি হবে। কমিটির সুপারিশ, নির্বাচনে কলেজের ক্ষেত্রে ‘ইলেকশন কনডাক্টিং অথরিটি’র মাথায় থাকবেন অধ্যক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ‘ডিন অফ স্টুডেন্টস’। নির্বাচনের গোটা প্রক্রিয়া ১৫ দিনের মধ্যে শেষ করে ফেলতে হবে এবং নির্বাচনের আগে ৪৮ ঘণ্টা কোনও রকম প্রচার করা যাবে না।
সুগতবাবু বলেন, “কোনও রাজনৈতিক দলের পোস্টার-পতাকা ক্যাম্পাসের ভিতরে বা আশপাশে লাগানো যাবে না। তবে নির্বাচনের প্রচার-পোস্টার নির্দিষ্ট জায়গায় লাগানো যাবে। মিছিলের জন্যও সময় নির্দিষ্ট করে দেবে প্রতিষ্ঠান।” নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি ছাত্র সংগঠনের আয়ব্যয়ের বার্ষিক অডিট করার সুপারিশও করেছে সংসদ।
কিন্তু হিংসা ঠেকানো যাবে কী ভাবে? রাজনৈতিক অনুপ্রবেশই বা বন্ধ হবে কী করে?
উচ্চশিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান জানান, কলেজের ভিতরে বহিরাগতদের প্রবেশ যতটা সম্ভব কমানোর কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, “ছাত্র নয়, এমন কেউ দরকারে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেই পারেন। কিন্তু ক্যাম্পাসে তাঁদের প্রভাব কমাতে হবে। সেটাই হবে যথার্থ অ-রাজনীতিকরণ।” কিন্তু কী উপায়ে তা করা যাবে, কমিটি তার কোনও সুলুকসন্ধান দেয়নি। শুধু বলা হয়েছে, গোলমাল হলে পুলিশ-প্রশাসনের সাহায্য নেবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। নিয়মবিধি চূড়ান্ত না-হওয়া পর্যন্ত মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের তত্ত্বাবধানে ছাত্র সংসদের নির্বাচন করতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। সুগতবাবু এ দিন জানান, যে-সব কলেজে এখনও ছাত্র সংসদের নির্বাচন বাকি আছে, সেগুলির তালিকা দ্রুত নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে রাজ্য সরকার। |