‘আমার নামে লন্ডনের স্টেশনই জীবনের সেরা স্বীকৃতি’
চুরি যাওয়া চার অলিম্পিক পদকের জন্য ক্লডিয়াসের চিঠি
ন্ডন অলিম্পিকের মুখে, তাঁর চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়া চারটে অলিম্পিক পদকের প্রতিরূপ ফেরত চাইছেন ভারতের সফলতম অলিম্পিয়ান। যার প্রথম সোনাটা পাওয়া ৬৪ বছর আগে লন্ডন গেমসেই।
ভারতীয় অলিম্পিক সংস্থার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির কাছে তাঁর এটাই আর্জি।
লন্ডনের ৩৬১ টিউব স্টেশনের নাম এখন ৩৬১ জন বিশ্বখ্যাত অলিম্পিয়ানের নামে।
প্রান্তিক একটা স্টেশনের নাম ‘ধ্যানচাঁদ’। তার আগেরটার নাম রূপ সিংহ। শেষ দিক থেকে তৃতীয় স্টেশনের নাম লেসলি ক্লডিয়াস। আরও তিনটি স্টেশন পরে ‘লেভ ইয়াসিন’, ছ’টা বাদে ‘বব বিমন’।
বুধবার বিকেলে লন্ডনের ওই স্টেশনগুলো হয়তো অলিম্পিকের মুখে জমজমাট। আর যে একমাত্র জীবিত ভারতীয় অলিম্পিয়ানের নামে স্টেশন, তিনি তখন কলকতায় তাঁর ২০/১ ম্যাকলিয়ড স্ট্রিটের বাড়িতে গলা পর্যন্ত চাদর টেনে শুয়ে। লেসলি ক্লডিয়াসের মাথার ঠিক ওপরে ক্রুশবিদ্ধ যিশু। অন্ধকার ঘরে টেলিভিশন থেকে যতটুকু আলো বেরোচ্ছে। বিছানায় টিভি রিমোটের ব্যাটারি ছড়ানো। সব রকম খেলা দেখাই তাঁর একমাত্র বিনোদন।
কথা বলছেন আস্তে। সামান্য জড়ানো গলা। কাছে গিয়ে শুনতে হচ্ছিল। “এমনি ঠিক আছি। ক’দিন আগে নাসিংহোম থেকে ফিরলাম। এখন ভাল। শুধু বয়সের জন্য দুর্বলতা।” আটচল্লিশের সেই লন্ডন অলিম্পিকেই ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ব্রিটেনকে ৪-০ হারিয়ে হকির সোনা জয়। খুব একটা উচ্ছ্বাস না দেখিয়েই শুয়ে শুয়ে বলছিলেন, “ওটা একতরফা ম্যাচ ছিল। সেরা ম্যাচ ছিল আসলে সেমিফাইনালে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে ২-১ জয়। ওরা দারুণ খেলেছিল।”
উঠে বসলেন অনেকক্ষণ বাদে তাঁর নামে লন্ডনের টিউব স্টেশনের কথা শুনে। “ওয়ান্ডারফুল আইডিয়া। এমন সম্মান জীবদ্দশায় পেয়ে সবচেয়ে ভাল লাগছে। আমি তো জানতাম না! যাঁর মাথা থেকে এটা বেরিয়েছে, তাঁকে ধন্যবাদ। এটাই মনে হচ্ছে জীবনের সেরা স্বীকৃতি।” স্ত্রী হাঁটেন ওয়াকার নিয়ে। হাসিমুখে বললেন, “আমি তো আগে এটা শুনেছি। তুমি ভুলে গেছ?”
তাঁর তিনটে অলিম্পিক সোনা, একটা অলিম্পিক রুপো চুরি হয়ে গেছে অনেক আগে। বাড়িতে কাঠের মিস্ত্রী শো কেস বানাতে এসে নিয়ে চলে গেছিল। থানা, পুলিশ করেও কিছু হয়নি। ৬৪ বছর আগে তাঁর প্রথম অলিম্পিকের শহরে গেমস ফিরে আসায় দুঃখটা এখন টের পাচ্ছেন। “আমি আসলে একটু অলস প্রকৃতির লোক। তাই চিঠি দেব দেব করেও এত দিনেও কিছু করা হয়নি। ক’দিন আগে গুরবক্স সিংহের কথায় আই ও এ-কে চিঠি দিয়েছি। যদি ওই পদকগুলোর রেপ্লিকা ফেরত পাওয়া যায়। আমার এক অস্ট্রেলিয়ান বন্ধু অলিম্পিক পদক হারিয়ে ফেলেছিল। ওর স্ত্রী আবার অর্ডার দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে। তখনই ভাবি, যদি আমারগুলো পেতাম।”
লন্ডন অলিম্পিকের সময় থাকতেন পার্ক লেনে। কুইন্স কোর্টের এই ১৪ নম্বর স্যুটে তার পরেই উঠে আসা। ক্লডিয়াসের স্মৃতিতে কখনও হানা দেয় লন্ডন, কখনও আবছা হয়ে যায়। আপনার তিনটে সোনার মধ্যে সেরা কোনটা? ক্লডিয়াস লন্ডনের জয় সহজ ছিল বলে ধর্তব্যে আনেন না। “আমার কাছে বাহান্ন-র সোনাটা সবচেয়ে দামি। লড়াই হয়েছিল দারুণ। সে বার আমি দারুণ ফর্মে ছিলাম। লন্ডনেরটা তার পরে আসবে।” সোনা জিততে এত মরিয়া ছিলেন, লন্ডন শহরটা ভাল করে ঘোরাই হয়নি। “আমাদের মাথায় ছিল প্র্যাক্টিস। কোচ ছিল না। ক্যাপ্টেন আর প্লেয়াররাই নিজেরা নিজেদের তাতাতাম। সে বার গেমস ভিলেজ ছিল না। আমরা থাকতাম একটা স্কুলে। স্কুল থেকে মাঠই শুধু যাতায়াত করেছি। শেষ বার লন্ডন গেছি ৫৯ সালে। ভারতীয়দের সঙ্গে ম্যাচ ছিল। সে বারও কিছু দেখা হয়নি।”
৬৪ বছর আগে ক্লডিয়াসের সময় লন্ডনে গেমস ভিলেজ ছিল না।
এখন যেখানে প্রতিযোগীদের জন্য অভিনব অভ্যর্থনার ব্যবস্থা। ছবি: রয়টার্স।
পদক তো নেই, চারটে অলিম্পিকের স্মৃতিজড়িত অন্য কিছু বাড়িতে আছে? জার্সি, পিন, মোজা, স্টিক? নিস্পৃহ গলায় যে উত্তরটা এল, তা ক্লডিয়াসের মতো সর্বকালের সেরাদেরই মানায়। “জানি না। থাকতে পারে। আমার বাথরুমের ওপরে দেরাজে বাক্সের মধ্যে পুরোনো সব জিনিসপত্র তোলা রয়েছে। তার মধ্যে যদি থাকে।” বোঝা গেল, পঁচাশি বছরের বৃদ্ধকে নাড়া দেয় না ও সব। চারটে অলিম্পিকের সেরা স্মৃতি তা হলে কিছু নেই? “লন্ডন অলিম্পিকের একটা কোট ছিল। তাতে অনেক অলিম্পিক পিন লাগানো ছিল। সেটা এক বন্ধুকে দিয়ে দিয়েছি।” ক্লডিয়াস হাসেন। এর পরে যদি ভাবেন ক্লডিয়াসের কাছে লন্ডনের স্মৃতি বলতে কিছু নেই, ভুল করবেন। বললেন, “লন্ডন অলিম্পিকের সেরা স্মৃতি হল, মার্চ পাস্টের সময় আমাদের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ঢোকা। তখন সবে স্বাধীন হয়েছে ভারত। হকিতে শোরগোল ফেলা টিম। আমরা ঢুকতে স্টেডিয়াম ভর্তি লোক যা চেঁচিয়েছিল, মনে আছে।” এখনও টিভিতে ওয়েম্বলির ফুটবল ম্যাচ দেখলে তাঁর মনে পড়ে স্টেডিয়ামটা।
লন্ডনে টিউব স্টেশনের নাম ‘ক্লডিয়াস’ শুনে আলো খেলেছিল মুখে। ফের আলো খেলল মোবাইলে মেলবোর্ন থেকে বন্ধুর ফোনে। ডিসেম্বরে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে আসবেন শুনে খুব খুশি। শুয়ে জড়ানো গলায় বন্ধুকে বলছিলেন, “আমি ভাল আছি। ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ ভাবে না। যা হওয়ার তাই হবে। ও সব ভেবো না।”
ওটাই যেন তাঁর প্রতীকী মন্ত্র। যা হওয়ার তাই হবে! পদক ফিরে না পেলেও কিছু এসে যায় না।
সন্ধে হয়ে আসছে দ্রুত। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে বাইরে। ও সব দেখার কোনও তাগিদ নেই ক্লডিয়াসের। একাত্তর সালে পদ্মশ্রী পেয়েছেন। তার পরে আর কোনও সরকারি সম্মান জোটেনি তিনটে অলিম্পিক সোনা, একটা রুপোর মালিকের (চারটে অলিম্পিক পদক ক্লদিয়াস ছাড়া ছিল শুধু প্রয়াত উধম সিংহের)। খেলায় প্রথম ভারতরত্ন পাওয়া উচিত কার? ধ্যানচাঁদ না সচিন বিতর্কের মধ্যে মনে হয় না, আপনারও দাবিদার হওয়া উচিত? ক্লডিয়াস ফের উদাসীন, “সচিন পেতেই পারে। আমার ফেভারিট ক্রিকেটার। আমার কথা আমি কী বলব? পেলে ভাল লাগবে।”
অসুস্থ অবস্থাতেও অতিথিকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার রীতি ভোলেননি। বেশ কষ্ট হয় হাঁটতে। ক্লডিয়াস ফিরে গেলেন স্বাধীনতার পরের বছরের লন্ডনে। “মার্চপাস্টটা এখনও মনে রয়েছে, ইয়ং ম্যান।”মার্চপাস্ট মনে রয়েছে। কিন্তু সেই অলিম্পিকের পদকটার কী হবে? বাকি তিনটে পদকের?




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.