সময় শেষ, প্যাক আপ!
লিউডের অভিধানে একটা নতুন শব্দ উপহার দিয়েছিলেন তিনি। ‘সুপারস্টার’।
৬৯ বছর বয়সে রাজেশ খন্নার প্রয়াণে বুধবার সেই প্রথম ‘সুপারস্টার’কে হারাল মুম্বই। কিংবদন্তি ‘আনন্দ’কে হারাল বলিউড। প্রকৃত মহাতারকার মতোই পর্দায় যাঁর উচ্চারণ ছিল, ‘জিন্দেগি বড়ী হোনি চাহিয়ে, লম্বী নেহি!’
জীবনে? ‘বাবুমশাই’ অমিতাভ বচ্চনের টুইট বলছে, রাজেশের শেষ কথা ছিল, “টাইম আপ হো গ্যয়া! প্যাক আপ!”
জিন্দেগি আর সফর, শব্দ দু’টো বারবার ঘুরে আসত রাজেশের গানের কলিতে। তাঁর জীবন-সফরও দীর্ঘ হল না। কিন্তু সাফল্যের নজির রইল অতিকায়। ১৯৬৯-১৯৭২, তিন বছরে পরপর ১৫টা সুপারহিট। রেকর্ড আজও ভাঙেনি।
রাস্তার দু’ধারে দু’টো সিনেমা হলে একসঙ্গে তাঁরই দু’দু’টো ছবি চলছে এবং দু’টোই সুবর্ণজয়ন্তী পার করছে এমন ঘটনা রাজেশ খন্নাই সম্ভব করেছিলেন। ১৯৬৭-১৯৭৫, রাজেশের সিন্দুকে ৩৫টা সুবর্ণজয়ন্তীর স্মারক জমা পড়ে যায়!
আরাধনা, আনন্দ, কাটি পতঙ্গ, আন মিলো সজনা, দো রাস্তে, অপনা দেশ, দাগ, হাতি মেরে সাথী, বাবুর্চি, অমর প্রেম, মেরে জীবনসাথী, নমক হারাম, আপ কি কসম...আসল নাম ‘যতীন’কে বদলিয়ে ‘রাজেশ’ রাখার সময়ে কি কেউ ভেবেছিল, এই নামটা স্টারডমের সংজ্ঞাই বদলে দেবে!
স্টুডিওতে আসতেন রাজেশ তাঁর গাড়ি ঢেকে যেত মেয়েদের লিপস্টিক-রঞ্জিত চুম্বনের দাগে। কোনও অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতেন রাজেশ জনতার টানাটানিতে ফর্দাফাঁই হয়ে যেত তাঁর জামা। ভিড় এড়াতে হয়তো মাঝরাতে হোটেলে ঢুকতে যাবেন রাজেশ চেন্নাইয়ের মতো শহরেও তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকত অন্তত ৬০০ মেয়ের জটলা। হাতের শিরা কেটে রাজেশকে চিঠি লেখা, রাজেশের ফটোগ্রাফে মালা পরিয়ে বিয়ে করা কোনও নায়ককে ঘিরে এমন উন্মাদনা তার আগে দেখা যায়নি। শর্মিলা ঠাকুর থেকে মুমতাজ, সবাই বলেন সে কথা। রাজেশ খন্নাই বলিউডে প্রথম নায়ক যাঁকে ভক্তদের হাত থেকে বাঁচতে পুলিশি প্রহরা নিতে হত। হাওড়া ব্রিজকে পিছনে রেখে ‘অমর প্রেমে’র গান শ্যুট করতে পারেননি শক্তি সামন্ত। পুলিশের ভয় ছিল, রাজেশ শ্যুটিং করলে ভিড়ের চাপে ব্রিজ ভেঙে পড়বে! অগত্যা নকল সেতু তৈরি করা হয়।
উদাহরণ অজস্র যা বলে দেবে দিলীপকুমার-দেব আনন্দ-রাজ কপূর-রাজেন্দ্র ‘জুবিলি’ কুমার-শাম্মী কপূর নয়, বলিউড কেন প্রথম বার ‘সুপারস্টার’ শব্দটা ব্যবহার করতে শুরু করেছিল রাজেশ খন্নার জন্যই। শুধু বলিউড? ১৯৭৪ সালে বিবিসি রাজেশকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানিয়েছিল। নাম, ‘বম্বে সুপারস্টার’!
হাই-নেক ‘গুরু’ পাঞ্জাবি, ঘাড় হেলানো মুচকি হাসি, সংলাপ বলার নাটকীয় ভঙ্গি, হাতের মুদ্রা, একের পর এক কালজয়ী গান...ষাটের শেষ-সত্তরের গোড়ার উদ্দাম বছরগুলোয় রোম্যান্টিকতার শেষ কথা রাজেশ। রাজ কপূরের উপরে চার্লি চ্যাপলিন, দেব আনন্দে গ্রেগরি পেক বা শাম্মীর উপরে এলভিস প্রেসলির প্রভাব ছিল স্পষ্ট। কিন্তু রাজেশ তাঁর ম্যানারিজম তৈরি করেছিলেন নিজের মতো করে। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, “আমাকে অনুপ্রেরণা দেয় দিলীপকুমারের একাগ্রতা আর গভীরতা, রাজের স্বতঃস্ফূর্ততা, দেব আনন্দের স্টাইল আর শাম্মী কপূরের ছন্দ।”
অমৃতসরে জন্মালেও দত্তক সন্তান হিসেবে বড় হওয়া রাজেশের শৈশব কেটেছে মুম্বই-সংলগ্ন গিরগাম এলাকায়। স্কুল থেকেই নাটকে অভিনয় করতেন। মুম্বইয়ের একটি প্রযোজক সংস্থা এবং একটি ফিল্মি পত্রিকা ১৯৬৫ সালে নতুন প্রতিভার খোঁজে একটি প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। ১০ হাজার প্রতিযোগীকে হারিয়ে জয়ী হন রাজেশ। সেই সুবাদেই প্রথম ছবি, চেতন আনন্দের ‘আখরি খত’ (১৯৬৬)। তার পর ‘রাজ’, ‘বাহারোঁ কে সপনে’, ‘আউরত’, ‘ইত্তেফাক’...। এলেন, দেখলেন, জয় করলেন বলাই যায়। এমনিতেও তথাকথিত ‘লড়াকু অতীত’ কখনওই ছিল না ওঁর। প্রযোজকদের কাছে চরিত্র চাইতে যেতেন বিদেশি গাড়ি চড়ে। সেই বছরগুলোয় রাজেশের সঙ্গী ছিলেন একদা সহপাঠী রবি কপূর। রবিই অল্প ক’দিনের মধ্যে ‘জিতেন্দ্র’ নামে খ্যাত হলেন। আর, ১৯৬৯ সালে রাজেশ ইতিহাস গড়ে ফেললেন যে ছবিটি দিয়ে, তার নাম ‘আরাধনা’। গোটা দেশের গলায় একটাই গান ‘মেরে সপনো কি রানি কব আয়েগি তু!’
‘আরাধনা’র পরিচালক ছিলেন শক্তি সামন্ত, শু্যটিং হয়েছিল দার্জিলিঙে। নায়িকা শর্মিলা ঠাকুর। বাংলার সঙ্গে যোগাযোগটা রাজেশের জন্য চিরকাল পয়া। শচীনদেব-রাহুলদেব-কিশোরকুমার তাঁকে সবচেয়ে বেশি হিট গান উপহার দিয়েছেন। একাধিক বাংলা ছবির রিমেকে নায়ক ছিলেন খামোশি (দীপ জ্বেলে যাই), সফর (চলাচল), অনুরোধ (দেয়া নেয়া), বাবুর্চি (গল্প হলেও সত্যি), অমর প্রেম (নিশিপদ্ম)..। সবচেয়ে বেশি প্রশংসা এসেছে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘আনন্দ’-এ।

১৯৬৯-১৯৭২, পরপর ১৫টি সুপারহিট ছবি। সেই রেকর্ড আজও অক্ষত।
চার দশকের কেরিয়ারে ৭৩টি গোল্ডেন জুবিলি, ২২টি সিলভার জুবিলি হিট।
রাজেশ, পঞ্চম, কিশোর ৩২টি ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছেন এই ত্রয়ী।
প্রথম প্লেব্যাক ’৬৭ সালে ‘বাহারোঁ কে সপনে’। পরে গেয়েছেন আরও ৭টি ছবিতে।
’৭৪-এ তাঁকে নিয়ে বিবিসি-র তথ্যচিত্র, বম্বে সুপারস্টার।
’৮৫ সালে প্রযোজক রাজেশের আত্মপ্রকাশ।
’৯২ সালে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে বিজেপি-র শত্রুঘ্ন সিন্হাকে হারিয়ে সংসদে।

‘বাবুমশাই এত ভালবাসা ভাল নয়’ বলে নিমেষে বাঙালির ‘ঘরের লোক’ হয়ে গিয়েছিলেন উত্তমকুমার-অনুরাগী রাজেশ। বাংলা ছবি অবশ্য করেননি। মৃণাল সেনের সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছিলেন, হয়নি। রাজেশ-শর্মিলাকে নিয়ে হিন্দিতে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ রিমেক করার কথা ভেবেছিলেন ঋত্বিক ঘটক, হয়নি।
রোম্যান্স আর ট্র্যাজেডিতে ভাল খুলত রাজেশের অভিনয়। জনপ্রিয় হতো তাঁর মৃত্যুদৃশ্য। রাজেশের ফিল্মি কেরিয়ারও সামগ্রিক বিচারে ট্র্যাজিকই। রাজেশ যেন সেই সম্রাট, ধূমকেতুর বেগে সাম্রাজ্যের উত্থান এবং প্রায় তত দ্রুত অবক্ষয় যাঁকে দেখতে হয়েছে।
১৯৭৩ সালে ‘ববি’ মুক্তি পাওয়ার আগেই ৩১ বছরের রাজেশ বিয়ে করেন ১৬ বছরের ডিম্পলকে। ওই বছরই এল অমিতাভর ‘জঞ্জীর’। রাজেশের জীবনে দু’টো ঘটনারই প্রভাব দূরপ্রসারী। বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। প্রকাশ্য কলহ রাজেশের রোম্যান্টিক ভাবমূর্তির ক্ষতি করেছে। অন্য দিকে অমিতাভের উত্থান হিন্দি ছবির গতিপথই বদলে দিয়েছে।
নব্বই দশকের গোড়া পর্যন্ত রাজেশ কমবেশি ছবি করেছেন ঠিকই। সৌতন, কুদরত, অগর তুম না হোতে, অবতার-এর মতো হিটও দিয়েছেন। কিন্তু সম্রাটের মুকুট মাথায় আর ওঠেনি। রাজেশ-ঘনিষ্ঠরা আরও একটা কথা বলেন রাজেশ কখনও বাস্তবতার বদলটা মানতে পারেননি, নিজেকেও বদলাননি। রাজকীয় মেজাজ আঁকড়েই জীবন কাটাতে চেয়েছেন। কংগ্রেসের টিকিটে এক বার সাংসদ হলেন (১৯৯২), পরের বার হারলেন। রাজনীতি থেকেও সরে গেলেন। ইদানীং বিজ্ঞাপনী চিত্রে বহু দিন পর এক শীর্ণ রাজেশকে দেখা যাচ্ছিল! সেখানেও তিনি বলছিলেন, “ফ্যানস্ ক্যায়া হোতা হ্যায়, মুঝসে পুছো!”
এপ্রিল মাস থেকেই বারবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছিল। তার মধ্যেও দিন কয়েক আগে বাংলোর বারান্দায় এসে ডিম্পল এবং জামাই অক্ষয় কুমারকে সঙ্গে নিয়ে ভক্তদের উদ্দেশে হাত নেড়ে গিয়েছেন। শেষ বার হাসপাতাল থেকে ফিরলেন দিন দুয়েক আগে। আজ দুপুরে জানানো হল, রাজেশ নেই। কী রোগ হয়েছিল, সেটা বলেননি চিকিৎসকরা।
ইন্ডাস্ট্রির ‘কাকা’ রাজেশ ছিলেন ধ্রুপদী বলিউডের শেষ রোম্যান্টিক নায়ক, যাঁর মুখে নরম আলো পড়ত। তার পরেই ছ’ফুট দু’ইঞ্চির রাগী যুবক একটা নতুন ইতিহাসের অবতারণা করবেন। কালক্রমে দু’জনেই প্রৌঢ় হবেন। ২০০৯ সালের এক বলিউড রজনীতে সেই অমিতাভর হাত থেকেই সারা জীবনের পুরস্কার নিয়ে রাজেশ বলে উঠবেন, “থ্যাঙ্ক ইউ বাবুমশাই!”
আর আজ ‘আশীর্বাদ’ বাংলোয় যখন শায়িত রাজেশের পা ছুঁলেন বয়সে দু’মাসের বড় অমিতাভ, জীবন আর পর্দা আবার মুখোমুখি। ‘আনন্দে’র শেষ দৃশ্যের ‘পুনরাবৃত্তি’!
জীবন তবু আলাদাই। তাই গভীর রাতে অমিতাভর টুইট, “নিথর শরীরটার সামনে দাঁড়িয়ে কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম।” পর্দায় ‘বাবুমশাই’ বলে উঠেছিল, “আনন্দ মরা নেহি, আনন্দ মরতে নেহি!”

ওঁর নিথর শরীরটার সামনে
দাঁড়িয়ে কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম।
মাথাটা একদম কাজ করছিল না....।
বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
মনে মনে ওঁর আত্মার প্রতি
শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলাম।
অমিতাভ বচ্চন
নিঃসন্দেহে তিনিই প্রথম
সুপারস্টার। বাকি অভিনেতাদের প্রতি
শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, রাজেশ যে
উন্মাদনা তৈরি করেছিলেন আর
কেউ তা করতে পারেননি। নয়
থেকে নব্বই, সবাই তাঁর ভক্ত।
শর্মিলা ঠাকুর
একটা সময় মা আর
আমি বসে পরের পর রাজেশ
খন্নার সিনেমা দেখতাম। জীবনের
কঠিন সময়ে তুমি বুঝিয়েছ,
ভালবাসা সব বদলে দেয়।
তোমায় মিস্ করব।
শাহরুখ খান
সংসদে ওঁর পাশে বসতাম।
সেন্ট্রাল হলে আড্ডা হতো। খুব
মজার মানুষ। এক বার দলের সভায়
আমন্ত্রণ করায় বলেছিলেন,
‘সেজেগুজে আসব কিন্তু’।
সেই হাসিমাখা মুখ ভুলিনি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ সিনেমা জগতের এক
বিখ্যাত কুশলী আমাদের ছেড়ে
চলে গেলেন। আমি খুব দুঃখিত।
ওঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা
জানাচ্ছি। ওঁর আত্মার
শান্তি কামনা করি।
লতা মঙ্গেশকর
দেখেছি, বয়স্ক মহিলারা
ওঁকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলছেন।
কম বয়সী মেয়েরা ওঁকে সামনে
দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।
এতটাই বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস ছিল
রাজেশ খন্নার উপস্থিতিতে।
শাবানা আজমি
রাজেশ খন্নার
মৃত্যুতে ভারতীয় সিনেমা
তার সবচেয়ে সফল ও
আকর্ষণীয় নায়ককে হারাল।
মনমোহন সিংহ
অসামান্য অভিনয় দক্ষতায়
সীমান্তের এ পারেও ভক্তকূল
তৈরি করেছিলেন রাজেশ খন্না।
রাজা পারভেজ আশরাফ
(পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী)
রাজেশ আমার
বন্ধু ছিল। ওঁর জন্য
গাইতে পেরে আমি
অত্যন্ত সম্মানিত।
মান্না দে



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.