মাত্র কুড়ি মিনিট মোবাইল ফোনে কথা বলুন। টের পাবেন, কান গরম হয়ে গিয়েছে।
এই অভিজ্ঞতা আমার-আপনার কাছে ‘সাধারণ’ ঘটনা হতে পারে। কিন্তু এর কুপ্রভাব মারাত্মক। আপনি জানতেও পারলেন না, ওই সময়টুকুর মধ্যেই কানে ফোন রাখার জন্য মস্তিষ্কের বাইরের দিকের তাপমাত্রা কিছুটা বেড়ে গিয়েছে। মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহ সেই বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রা একটু পরে নামিয়ে আনতে পারলেও চোখের কর্নিয়ার ক্ষেত্রে সেই রকমের কোনও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। ফলে মোবাইলে টানা কথা বলার ‘থার্মাল এফেক্ট’-এ ক্ষতি কিছু হচ্ছেই। মস্তিষ্কের, এমনকী হৃদ্যন্ত্রেরও। মোবাইলের জন্য কাছের যে টাওয়ারটি রয়েছে, কম ক্ষতিকর নয় সেটিও।
মোবাইলের ব্যবহার এখন যে মাত্রায় পৌঁছেছে, তাতে এর বিপদের দিকগুলি নিয়ে নড়ে বসতে হচ্ছে সরকারকেও। কেন্দ্রের তিনটি মন্ত্রক নিয়ে গঠিত বিশেষ কমিটি ও বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ, টাওয়ারগুলির বিকিরণ ও মোবাইল ফোনের সেই বিকিরণ গ্রহণের মাত্রা (স্পেসিফিক অ্যাবজর্পশন রেট বা এসএআর) নিয়ন্ত্রণে এ বার আইন সংশোধনের কথা ভাবতে হবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, এখনই দেশের সমস্ত মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণের মাত্রা অন্তত ১০ শতাংশ কমাতে হবে।
কেন্দ্রের আন্তঃমন্ত্রক গোষ্ঠী মনে করছে, সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলার কাজেও অনেক বেশি তৎপর হতে হবে সরকারকে। কারণ, টাওয়ারের বিকিরণের প্রভাবের পাশাপাশি মোবাইল সেটের এসএআর সম্পর্কেও সাধারণ মানুষের তেমন ধারণা নেই। ফলে মোবাইল সেট কেনার সময় ওই মাত্রা বিশেষ কেউ দেখেন না।
আম্তঃমন্ত্রক কমিটির রিপোর্টে এ-ও উল্লেখ করা হয়েছে যে, শুধু মোবাইল নয়, জনবসতির মধ্যে টাওয়ারগুলি যে বিকিরণ ছড়াচ্ছে, তার কুপ্রভাবও পড়ছে মস্তিষ্ক ও হৃদ্যন্ত্রে। অবসাদ, ঘুমের ব্যাঘাত, ঝিমুনি ভাব বেড়ে যাওয়া, মনঃসংযোগে সমস্যা, স্মৃতিশক্তি বিলোপ, মাথাব্যথা, হজমের ক্ষমতা কমে যাওয়া, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার মতো নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। মোবাইল ব্যবহার না করেও বিকিরণের শিকার হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতীরা। কুপ্রভাব এড়াতে পারছে না পশুপাখিরাও।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) গত বছরই এক সতর্কবার্তায় জানিয়েছিল, মোবাইল ফোনের বিকিরণ থেকে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। দশ বছর ধরে ১৩টি দেশে করা তাদের সমীক্ষা বলছে, দিনে এক-দু’ঘণ্টা মোবাইল ফোনে কথা বললেই গ্লিয়োমা (মস্তিষ্কের টিউমার) হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সেই সঙ্গে যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা টাওয়ারগুলির বিকিরণও বিপদ ডেকে আনছে নিঃশব্দে।
|
আন্তঃমন্ত্রক কমিটির সুপারিশ |
|
আপনি কী করবেন |
• মোবাইলে বেশি ক্ষণ ও টানা কথা বলা এড়ান। কাজ সারুন এসএমএসে।
• হ্যান্ডস-ফ্রি বা ব্লু-টুথ তুলনায় ভাল।
• সতর্কতা বেশি জরুরি শিশু, কিশোর ও গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে।
• গাড়ি বা ঘরে নয়, কথা বলুন খোলা জায়গায়, যেখানে সিগন্যাল ভাল।
• তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ গ্রহণের মাত্রা ‘এসএআর’ কম কি না দেখে ফোন কিনুন।
• চিকিৎসার যন্ত্রপাতি থেকে মোবাইল দূরে রাখুন। |
সরকারের করণীয় |
• টাওয়ারের বিকিরণ মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আইন সংশোধন করা হোক।
• ঘনবসতিতে টাওয়ার বসানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি।
• টাওয়ারগুলিকে স্কুল, খেলার মাঠ, হাসপাতাল থেকে দূরে রাখা। |
|
এলাকায় টাওয়ার বসার পর মস্তিষ্কে ক্যানসারের অভিযোগ নিয়ে ইদানীং অনেকে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতেই বিষয়টি নিয়ে সমীক্ষার জন্য টেলিকম, পরিবেশ এবং জৈব-প্রযুক্তি মন্ত্রকের কর্তাদের নিয়ে কমিটি গঠন করে কেন্দ্র। সামিল করা হয় বিশেষজ্ঞদেরও। কমিটির রিপোর্ট বলছে, বিভিন্ন গবেষণায় বিকিরণের জেরে শরীরে ডিএনএ-র পুনর্বিন্যাস ও ক্রোমোজোমের ক্ষয়ের লক্ষণ দেখা গিয়েছে। কিন্তু মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণ থেকে সরাসরি ক্যানসার হতে পারে, এমন কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চাইছে না কেন্দ্র। তাদের মতে, এখনও কোনও গবেষণায় ওই বিকিরণের সঙ্গে ক্যানসারের সরাসরি যোগাযোগ প্রমাণিত হয়নি।
বিকিরণ ছড়ায় টিভি-রেডিওর টাওয়ারগুলিও। তবে মোবাইলের টাওয়ার নিয়ে কেন এত উদ্বেগ? টেলিকম মন্ত্রকের এক কর্তার মতে, দেশে টিভি-রেডিও টাওয়ারের সংখ্যা দু’হাজারও পেরোবে না। কিন্তু মোবাইল টাওয়ার কয়েক লক্ষ। এগুলি থেকে নিরন্তর তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে। এখন আবার মোবাইলের সাধারণ পরিষেবার পাশাপাশি ওয়্যারলেস ইন্টারনেটের কদর বেড়েছে। ফলে বেড়ে গিয়েছে বিকিরণের মাত্রাও।
সমস্যার আর একটি দিক হল, আমরা যখন ফোনে কথা বলি না, তখনও ওই বিকিরণ আমাদের ক্ষতি করে চলে। মোবাইল অন থাকলেই তাতে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আসতে থাকে টাওয়ার থেকে। কানে ফোন নিয়ে কথা বলার সময় সেটি মস্তিষ্কের একেবারে কাছে চলে আসে। বিকিরণ প্রবাহিত হতে থাকে শরীরের মধ্য দিয়ে। আর মোবাইল টাওয়ার ও তার শক্তিশালী অ্যান্টেনার কাছাকাছি বসবাস করা তো আরও ক্ষতিকর।
যদিও বাড়ির সামনে টাওয়ার বসলে অনেকে উৎসাহিতই হন। এই ভেবে যে, এলাকায় সিগন্যাল ভাল পাওয়া যাবে। কিন্তু এতে নিঃশব্দে যে ক্ষতি হচ্ছে, অনেকেরই সেই ধারণা নেই। অভিনেত্রী জুহি চাওলা গত বছর মুম্বইয়ের মালাবার হিলস্-এ তাঁর বাড়ির সামনে রাজ্য অতিথি নিবাসে মোবাইল টাওয়ার বসানোর প্রতিবাদে রীতিমতো আন্দোলনই শুরু করেছিলেন প্রতিবেশীদের নিয়ে। স্থানীয় সাংসদ মিলিন্দ দেওরা থেকে মুখ্যমন্ত্রীসবার কাছে চিঠি লিখে টাওয়ার সরানোর দাবি জানান তাঁরা।
মোবাইল টাওয়ার থেকে মানব শরীরে প্রভাব নিয়ে কেন্দ্রের কাছে বছর দেড়েক আগে একটি রিপোর্ট পেশ করেন ‘বম্বে’ আইআইটি-র ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক গিরীশ কুমার। তিনি বলেন, “জুহির আন্দোলনে টাওয়ার সরিয়ে নেওয়ার অর্থ এক প্রান্তের বদলে অন্য প্রান্তের মানুষদের বিপদে ফেলা। তাই, হয় ওই টাওয়ারগুলির শক্তি কমাতে হবে, নয়তো সেগুলি সরিয়ে দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। সরকারের রিপোর্টও বলছে, এখনই এই বিকিরণের মাত্রা দশ ভাগের এক ভাগ কমাতে হবে।”
আন্তঃমন্ত্রক কমিটির রিপোর্টেও সুপারিশ করা হয়েছে, এই বিকিরণের কুপ্রভাব নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও সক্রিয় হতে হবে। ২০০৯ সালে কেন্দ্র কিছুটা বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল বটে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতিও বদলেছে। তাই কমিটির সুপারিশ, আইন সংশোধন করে টাওয়ার থেকে বিকিরণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হোক। বেঁধে দেওয়া হোক মোবাইল হ্যান্ডসেটের এসএআর-ও। |