পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়াছিলেন। উদ্দেশ্য, এই রাজ্যের জন্য বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা। তিনি প্রবাসী বাঙালিদের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন, ভারত-মার্কিন বাণিজ্য পরিষদের সহিত বৈঠক করিয়াছেন। প্রত্যাবর্তনের পর তিনি জানাইয়াছেন, বাংলা সম্বন্ধে প্রবাসীদের আগ্রহ বাড়িতেছে। অন্য ভাষায় বলিলে, বাংলার সম্ভাবনার প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা এখনও বিনষ্ট হয় নাই। কথাটিতে বঙ্গবাসীর আনন্দিত হইবার কারণ আছে কি? কাহারও মধ্যে সফল হইবার সম্ভাবনা আছে এই কথাটির দুইটি অর্থ সম্ভব। প্রথম অর্থ হইল, সেই ব্যক্তি (বা রাজ্য) ভবিষ্যতে সত্যই সফল হইতে পারে, উন্নতি করিতে পারে, বক্তা এমন আশা পোষণ করিতেছেন। দ্বিতীয় অর্থটি সরাসরি নহে, একটু ঘুরাইয়া বলা রাজ্যটি এখনও পর্যন্ত কিছুই করিয়া উঠিতে পারে নাই, এবং ভবিষ্যতেও যে পারিবে, তেমন আশা নাই। অর্থমন্ত্রীকে মার্কিন দুনিয়ার প্রশংসাকারীরা মিষ্টবাক্য শুনাইয়াছেন। মিষ্টভাষী অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, ভাষার মিষ্টতা সর্বদা ভাবের যাথার্থ্য বহন করে না। প্রিয়বাক্য এবং সত্যবাক্য সচরাচর সহযাত্রী নহে।
পশ্চিমবঙ্গের সম্ভাবনা আছে, এই কথাটি নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছে, এমন ধরিয়া লওয়ার বিস্তর কারণ আছে। একটির উল্লেখ প্রাসঙ্গিক। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ কার্যত অসম্ভব একটি ব্যাপার। তাহাতে বহুবিধ বাধা। একটি বাধার নাম ‘১৪ ওয়াই ছাড়পত্র’। এই রাজ্যে ২৪.৮ একরের ঊর্ধ্বে জমি কিনিতে গেলে সরকারের অনুমতি আবশ্যক। তাহারই নাম ১৪ ওয়াই ছাড়পত্র। বৃহৎ শিল্প গড়িতে স্বভাবতই এই মাপের অধিক জমি প্রয়োজন। ফলে, শালবনির লৌহ-ইস্পাত প্রকল্প হইতে কাটোয়ার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সবই এই বিশেষ ছাড়পত্রের অপেক্ষায় আটকাইয়া ছিল। গত এপ্রিলে রাজ্য সরকার ১৯৫৫ সালের ভূমি সংস্কার আইন সংশোধন করিয়া বৃহৎ শিল্পের জন্য জমির এই ঊর্ধ্বসীমা শিথিল করিবার সিদ্ধান্ত করে। কিন্তু, বিধানসভার সিদ্ধান্তটি অদ্যাবধি আইন রূপে প্রজ্ঞাপিত হয় নাই। এই প্রক্রিয়ায় যত সময় লাগা স্বাভাবিক, তাহার কয়েক গুণ সময় ইতিমধ্যেই মহাকরণের অলিন্দে বহিয়া গিয়াছে। ফলে, তিন-তিনটি সরকারি প্রকল্প কাটোয়ায় এন টি পি সি-র তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, ডানকুনিতে বামার লরি-র লজিস্টিকস হাব এবং আলিপুরদুয়ারে পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশনের সাবস্টেশন আটকাইয়া রহিয়াছে। যে রাজ্যে এমন অবস্থা সম্ভব, তাহার সম্বন্ধে বিনিয়োগকারীদের বিস্ময় থাকিতে পারে, কৌতূহলও, কিন্তু কৌতূহল এবং আগ্রহ এক বস্তু নয়।
পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে মার্কিন আশাবাদটি যদি সম্পূর্ণত ইতিবাচকও হয়, তবুও তাহাতে সন্তুষ্ট হইবার অবকাশ নাই। সম্ভাবনায় পেট ভরে না। সম্ভাবনার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার শাসনকালের প্রথম এক বৎসরে সেই পথে বিশেষ অগ্রসর হইতে পারেন নাই। বরং, বিভিন্ন প্রসঙ্গে তাঁহার ‘জেদ’, উন্নয়ন হইতে মুখ ফিরাইয়া রাখিবার প্রয়াস ভুল বার্তা পাঠাইয়াছে। বাম শাসনকালেই বিদেশি বিমান সংস্থাগুলি একে একে কলিকাতার সংস্রব ত্যাগ করিতেছিল। নূতন জমানায় তাহারা ফেরে নাই। প্রশাসনের প্রধান হিসাবে ইতিবাচক বার্তা প্রেরণ করিবার দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রীর। শিল্পায়নের প্রতি তাঁহার দায়বদ্ধতা প্রমাণ করিতে হইবে। বিপ্লব-বাসনা ও দীর্ঘসূত্রতা, বাম আমলের এই দুইটি ভূতকে ঝাড়িয়া ফেলিবার সময় আসিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী কলিকাতাকে সাজাইতেছেন, বিমানবন্দরের উন্নতিসাধন হইয়াছে। সকলই সুলক্ষণ, এবং বিনিয়োগকারীদের নিকট এই সঙ্কেতগুলির গুরুত্ব কম নহে। কিন্তু একই সঙ্গে প্রশাসনিক তৎপরতা, শিল্পকে সাহায্য করিবার মানসিকতার প্রমাণও পেশ করিতে হইবে। যদি করিতে পারেন, বিদেশ হইতে তখন আর শুধু ইতিবাচক মনোভাবের মিষ্টবার্তাই আসিবে না, প্রকৃত বিনিয়োগ আসিবে। |