মেলালেন তিনি মেলালেন।
তিনি নেপালি কবি ভানুভক্ত।
জিটিএ নির্বাচনে লড়াই নিয়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্কে যে সাম্প্রতিক ‘টানাপোড়েন’ তৈরি হয়েছিল, শুক্রবার তা মিটে গেল মোর্চা প্রধান বিমল গুরুঙ্গের সঙ্গে তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকে। যে বৈঠকের পরে গুরুঙ্গ বললেন, “গত দু’তিন দিনে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তা মিটে গিয়েছে।”
এমনিতে নির্বাচনের ফলাফল সর্বসমক্ষে এসেই গিয়েছে জিটিএ বোর্ড গড়তে চলেছে মোর্চা। আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটুকুই যা বাকি। কিন্তু মমতা চেয়েছিলেন, ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে’ বিনা ভোটে যেন কিছু না-হয়। দলের অন্দরে তিনি জানিয়েছিলেন, ভোটে লড়তেই হবে। সেটা ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ লড়াই হলেও। সেই আবহেই এ দিন মমতা ভানুভক্তের জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে বলেন, “বিভেদ করা সহজ। ঐক্য করা কঠিন। আপনারা ঐক্য রাখুন। শান্তি রাখুন। তা হলেই উন্নয়ন হবে। আমি বারবার এখানে আসব।”
আরও বলেছেন, “সময় নষ্ট করা যাবে না। আসুন, সকলে এক সঙ্গে কাজ করি। আমি ভোটের প্রচারে আসিনি। আপনাদের জায়গা দখল করতেও আসিনি।” |
মমতার বক্তব্যের শেষ অংশ ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। কেন না, গুরুঙ্গ ভেবেছিলেন, পাহাড়ে তাঁরা ‘একচ্ছত্র’ ভাবে জিটিএ ভোটে ‘লড়বেন’। সিপিএম প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেওয়ায় একটা দিক পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তৃণমূলের ১৭ জন প্রার্থী এখনও ভোটে লড়ছেন। যাতে যথেষ্ট ‘ক্ষুব্ধ’ হয়েছিলেন গুরুঙ্গ। এমনকী, বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ভেবেছিলেন, ভানুভক্তের জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে মোর্চার কোনও প্রতিনিধিকে পাঠাবেনই না! গুরুঙ্গ শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকলে নিশ্চিত ভাবে তা নির্বাচনের ওপর ‘ছায়া’ ফেলত। ‘ছায়া’ ফেলত পাহাড় নিয়ে মমতার ‘সাফল্যে’র উপরেও। বিরোধী সিপিএম যার সুযোগ নিত।
মমতা তা হতে দেননি।
এ দিন গুরুঙ্গের সঙ্গে বৈঠকের ‘সাফল্যে’র পরে রাতেই ফেসবুকে তাঁর পেজ-এ মমতা নব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ‘শুভেচ্ছা’ জানিয়েছেন। ফেসবুকে মমতা লিখেছেন, ‘দীর্ঘদিন পরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেনে জিটিএ চুক্তি অনুযায়ীই ওঁরা নির্বাচিত হয়েছেন।’
মমতা-গুরুঙ্গ বৈঠকের পর তৃণমূল প্রার্থীরা কী করবেন? এখনই বলা কঠিন। তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ মনে করেন, মোর্চাকে একেবারে ফাঁকা মাঠ ছাড়া ঠিক নয়। আবার অন্য অংশ মনে করেন, মোর্চার ধারণা হয়েছে, পাহাড়ে মমতার নিজস্ব ভোট-ব্যাঙ্ক তৈরি হয়েছে। তৃণমূলের প্রার্থীদের জামানত গেলে সেই ধারণাটা ভেঙে যাবে। যা তৃণমূল এবং মমতার পক্ষে ‘ঠিক নয়’। ফলে শেষ মুহূর্তে লিফলেট দিয়ে ভোটে না-লড়ার কথা জানানো হোক।
জিটিএ নির্বাচনের জন্য এমনিতেই দার্জিলিংয়ে নির্বাচনী আচরণবিধি চালু। তাই মমতা কোনও সরকারি কর্মসূচি পাহাড়ে রাখেননি। কিন্তু ‘ঘটনাচক্রে’, ভানুভক্তের জন্মবার্ষিকী পড়ে যাওয়ায় সরকারের তরফে রাজ্য নির্বাচন দফতরের থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে মমতা সেই অনুষ্ঠানে আসেন। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়-সফর করতে চেয়েছিলেন একটাই কারণে যাতে মোর্চার সঙ্গে কোনও ‘ভুল বোঝাবুঝি’ না-হয় এবং পাহাড়ে দাঁড়িয়েই মোর্চাকে যাতে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ‘বার্তা’ দিতে পারেন। |
সেই পরিকল্পনা মতোই সফর চলছিল। গোল বাধে মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময়সীমা শেষের পরেও তৃণমূল ময়দানে থেকে যাওয়ায়। এর ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ‘ভারসাম্য’ যে খানিকটা হলেও টলে গিয়েছে, মমতা তা জানতেন। জেনে কিঞ্চিৎ উচাটনও ছিলেন। তিনি আরও জানতেন, মোর্চা তাঁর অনুষ্ঠান বয়কট করলে সমস্যা বাড়বে।
ফলে বৃহস্পতিবার রাত থেকে ‘তৎপর’ হন তৃণমূল নেতৃত্ব। ‘তৎপর’ হয় প্রশাসনও। নাটকীয় দ্রুততায় পট পরিবর্তন হয়। এ দিন সকালে জানা যায়, মোর্চার নেতা রোশন গিরি এবং তাঁদের বিধায়কদের কালিম্পঙের অনুষ্ঠানে পাঠাচ্ছেন গুরুঙ্গ। কিন্তু মমতার তো দরকার তাঁর সঙ্গে খোদ গুরুঙ্গের প্রকাশ্য উপস্থিতি এবং গুরুঙ্গের তরফে ‘ইতিবাচক’ বার্তা! ফলে গুরুঙ্গকে বোঝানো হয়, তৃণমূলের প্রার্থীরা ভোটে লড়লেও মমতা তাঁদের সঙ্গে দেখা করেননি। করছেন না।
এই পরিস্থিতিতে গুরুঙ্গ মমতার সঙ্গে দেখা করলে ওই প্রার্থীদের কাছে ‘বার্তা’ যাবে। দ্বিতীয়ত, গুরুঙ্গকে মমতা ভোটে ‘জয়ে’র জন্য অভিনন্দন জানালে সেটা মোর্চা-প্রধানের কাছে ‘উপরি পাওনা’ হবে। পাশাপাশি, সিপিএম প্রার্থী তুলে নেওয়ায় গুরুঙ্গ তাদের আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ জানানোয় প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে যে ‘উদ্দীপনা’ দেখা দিয়েছে, তৃণমূলের তরফে তা স্তিমিত করা যাবে। গুরুঙ্গের সঙ্গে দেখা করে মমতাও সিপিএমকে ‘বার্তা’ দিতে পারবেন, মোর্চা-তৃণমূল কোনও লড়াই নেই।
বাস্তবে মমতার সেই পরিকল্পনা সফল। এতটাই যে, বৈঠকের পর মমতা বলছেন, গুরুঙ্গ তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও তৃণমূলের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন তাঁরা এবং একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে মোর্চার প্রতিনিধি থাকবেন।
পরিস্থিতির যে ‘উন্নতি’ হচ্ছে, তা বোঝা গেল, যখন কালিম্পঙের মঞ্চে রোশনদের সঙ্গেই হাজির হলেন বিমল গুরুঙ্গের স্ত্রী আশা। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর এল, বিমলও আসছেন মঞ্চে। তবে রাস্তায় দেরি হয়ে যাওয়ায় বিমল আর মঞ্চে পৌঁছতে পারেননি। তিনি সার্কিট-হাউসে এসে মমতার সঙ্গে দেখা করেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই ছিলেন রেলমন্ত্রী মুকুল রায় এবং উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। |
মমতা অবশ্য তার আগে যেচে কালিম্পঙের মোর্চা বিধায়ক হরকা বাহাদুর ছেত্রীর বাড়িতে গিয়ে চা খেয়ে এসেছেন। তৃণমূল সূত্রে যাকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে গুরুঙ্গের প্রতি ‘বার্তা’ বলেই। কারণ, মোর্চার অন্দরের রাজনীতিতে হরকা বাহাদুর মমতা-প্রশ্নে খানিকটা ‘নরমপন্থী’ বলেই পরিচিত। হরকা বাহাদুরের বাড়িতে চা-পানের পর সার্কিট-হাউসে গুরুঙ্গ-মমতা সাক্ষাৎ। যে বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “পর্যটনে আমরা ওঁদের পুরো সাহায্য দেব। জিটিএ চুক্তি অনুযায়ী ওঁরা ২০০ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সাহায্যও পাবেন। পাহাড়ে শিল্প হলে যাতে কেন্দ্র কর-ছাড় দেয়, তা নিয়েও আমরা উদ্যোগী হব।”
আর বিমল?
মোর্চা-প্রধানের কথায়, “ভাল মিটিং হয়েছে। ভুল বোঝাবুঝি মিটে গিয়েছে। আমরা এক সঙ্গে কাজ করতে চাই।”
তা হলে ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়েছিল কেন?
গুরুঙ্গের জবাব, “উনি (মমতা) তো আমাদের মায়ের মতো। সন্তানরা তো মা’কে মাঝেমধ্যে জ্বালাতন করেই।”
সাধে কি তৃণমূলের সাংসদ বলছেন, “জয় ভানুভক্তের জয়।”
মেলালেন তিনিই মেলালেন! |