মাটির মানুষ
পুরনো শস্য-গানের পরম্পরা
বেঁচে আছে মিথিলার কণ্ঠে
পুরুলিয়ার জরাডি পঞ্চায়েতের একটেরে গ্রাম সগড়কা। তারই এক প্রান্তে গ্রামের ‘কুলী’র (পথ) ধারে বসবাস পঞ্চাশ পার, মিথিলা মাহাতর। একেবারে আটপৌরে এই মহিলার স্মৃতি ও কণ্ঠে এখনও সজীব আছে নানা শস্য-পরবের গান। পরবের সময় হলে দল নিয়ে তিনি শস্য গানে নেতৃত্ব দেন এবং নাচেনও।
বলা বাহুল্য, শস্যের, বিশেষত ধানের বীজ বপন এবং রোপণ (রোয়া) এবং শস্য তোলার ‘সময়’ অনেক জেলায় বদলেছে আধুনিক কৃষি কাজের ধারা। বহু ফসলে সদা ব্যস্ত কৃষি-কৃষক ও ভূমি। কিন্তু গান হারায়নি বয়স্কা মহিলাদের কণ্ঠে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, স্কুল-কলেজে পড়তে যাওয়া কন্যাদের বেশি আগ্রহ নেই এতে। জানা গেল, শহর পুরুলিয়া থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে সগড়কা গ্রামে এসে।
এ-ও জানা গেল, বছরে দু’তিন বার ধান (কিছু অঞ্চলে) ফললেও, চাষিরা এখনও আমন অর্থাৎ শীতের ধানের ওপরই আশা-ভরসা রাখেন। এবং তার বীজতলা (সিড-বেড) তৈরি হয় মাঝ জ্যৈষ্ঠে। নির্দিষ্ট তারিখ, জ্যৈষ্ঠি মাসের তেরো তারিখে। এটাই ‘রহিন পরব’ বা বীজ পুহ্না (বপন)। আসলে রোহিণী নক্ষত্রটি পৃথিবীর খুব কাছে এসে পড়ে তখন। শুকনো মাটিতে ধানের বীজ ছড়ালে ওই সময় বৃষ্টি হয়। যদিও প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্যে এ বিশ্বাস টলেছে। কিন্তু লোক ধর্মের ‘আচার’-এ বেঁচে আছে রোহিণী-বিশ্বাস।
“ই সব কথা আপনাদের বইয়ে লিখা আছে। আমরা কী জানি? আমরা কাজ-কাম করি। সংসার পালি। রোহিনে গান গাই। ভাদরে ধান কুয়া শেষে ‘পারশো’ (পার্শ্ব) একাদশীতে গ্রামের বউ-ঝিদের নিয়ে জাওয়া গান গাই। লাচি। উটি আমাদের ধরম-করম,” উত্তরে সারল্য, মিথিলা মাহাতর। ঠিক কথা। এত শত ছাপা ব্যাখ্যা জানার কথা নয় মিথিলার। এ-ও জানার কথা নয় যে, শ্রীকৃষ্ণের বড় ভাই বলরাম ভারতীয় বিশ্বাসে কৃষি দেবতা। তাঁর রূপ হলধরধারী। বলরামের মায়ের নাম রোহিণী। সুতরাং রোহিণী নক্ষত্রে বীজ ছড়ানোর সময় তো দেবতা বৃষ্টি দেবেনই।
শীতের ধান অর্থাৎ পৌষালি ধান রোয়ার পরে, তা একটু বড় হলেই কৃষি সংসারে অবসর বেশি। ভাদ্র মাসের পাশ্বর্র্ একাদশীর আগে থেকে গ্রামের পথ, বাড়ির অন্দর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে নিজেদের তৈরি করে নেয়। তার পরেই সকাল-বিকেল ভাল ফলনের আশায়, শুধু মাত্র মহিলারাই শস্য গান ‘জাওয়া’ গেয়ে চলেন। নাচেনও। বাজনা বাজান অবশ্য পুরুষেরা।
কোথায় শিখলেন এমন গান? “ই গান তো শিখার কিছু নাই। পাড়া থানার চিত্রা গাঁয়ে বাপের বাড়ি। বিয়ে হয়ে এই সগড়কায় আলাম। গান আলি আমার সনে। ভাদ্র মাসের পারশ একাদশীতে করম গাছের ডাল পোঁতা হবে। দেবতার থান হবে উটি। এ বার গান হবে। হবে নাচও,” জানালেন মিথিলা। কুমারী মেয়েরা আগে ‘জাওয়ার মা’ সাজত। তিনি হতেন মূল ব্রতের নায়িকা। জানা গেল, সে প্রথা লুপ্ত। চেলিয়ামা বাসিকা বিদ্যালয়ের বারো ক্লাসের ছাত্রী বেদন্তা মাহাত, বিবাহিত, জানালেন গানের বিষয়। যাতে দেব-দেবীদের সুখ-দুঃখের সাথি হওয়া। বেহুলার বিবাহ জীবনের বিপর্যয় করম উৎসবের জাওয়া গানের বিষয় বস্তু হিসেবে এসে যায়।
আর রাম-রামায়ণ যে ভারতের গ্রাম জীবনের প্রাণ তা শোনা গেল এই গানে। বেদন্তার কণ্ঠে
‘রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাই
যমুনা সিনাতে (স্নানে) যায়
সিনাই আসে সিনাই আসে
দুয়ারে দাঁড়াই।
রে করম চলি আয়
চৌকাঠেতে লিখা রয়
চোদ্দ বছর বনে যায়।’

“গ্রাম জীবনের এমন সব গান, লোক কথায় মূল পাঠ ভেঙে তৈরি করে নেন মহিলারা। এ তাঁদের একান্ত উপলব্ধির কথা,” বললেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিহির চৌধুরী কামিল্যা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.