|
|
|
|
আপাতত ‘স্বস্তি’ সিপিএমের |
নন্দীগ্রাম নিখোঁজ-মামলায় ‘শর্তাধীন’ জামিন লক্ষ্মণের |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
জেল হাজতে ১১৮ দিন কাটানোর পরে শর্তাধীনে জামিন পেলেন পূর্ব মেদিনীপুরের সিপিএম নেতা, তমলুকের প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ।
কলকাতা হাইকোর্ট শুক্রবার নন্দীগ্রাম নিখোঁজ-কাণ্ডের অন্যতম মূল অভিযুক্ত লক্ষ্মণবাবুর জামিন মঞ্জুর করলেও এ দিন কিন্তু তিনি মুক্তি পাননি। বর্তমানে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রয়েছেন লক্ষ্মণবাবু। তাঁর আইনজীবীরা জানিয়েছেন, হাইকোর্টের নির্দেশ নিয়ে হলদিয়ার অতিরিক্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এ বার আবেদন জানাতে হবে। জামিন নিতে হবে ওই আদালত থেকেই। তার পরে জেল থেকে ছাড়া পাবেন লক্ষ্মণবাবু। সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ কবে ছাড়া পাবেন, তা নির্ভর করছে ওই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার উপরেই।
এর আগে একাধিক বার বিভিন্ন আদালত লক্ষ্মণবাবুর জামিনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল। হলদিয়া পুরভোটের আগে গত মে মাসে তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করে হাইকোর্ট। তবে এ দিন হাইকোর্টেই বিচারপতি অসীম রায়ের ডিভিশন বেঞ্চ শর্তাধীনে জামিন দিয়েছে লক্ষ্মণবাবুকে। শর্ত অনুযায়ী হাইকোর্ট পরবর্তী নির্দেশ না-দেওয়া পর্যন্ত নিজের জেলা পূর্ব মেদিনীপুরে ঢুকতে পারবেন না ওই সিপিএম নেতা। এবং যে থানা এলাকায় তিনি থাকবেন, সেখানকার ওসি-র কাছে মাসে দু’দিন তাঁকে হাজিরা দিতে হবে। প্রসঙ্গত, নন্দীগ্রাম নিখোঁজ-কাণ্ডে গত ১৭ মার্চ মুম্বই থেকে সিআইডি গ্রেফতার করেছিল লক্ষ্মণবাবু ও পূর্ব মেদিনীপুরের আরও দুই সিপিএম নেতাকে। |
|
আলিপুর জেল থেকে ফেরার পথে তমালিকা পণ্ডা শেঠ। শনিবার। —নিজস্ব চিত্র |
পশ্চিম মেদিনীপুরের সুশান্ত ঘোষের পরে এ বার পূর্ব মেদিনীপুরের লক্ষ্মণবাবুর জামিন পাওয়ার ঘটনায় আপাতত কিছুটা ‘স্বস্তি’ পেয়েছে সিপিএম। আদালতের এই নির্দেশকে হাতিয়ার করেও রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’র অভিযোগ এনেছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। শাসক দল তৃণমূলের অবশ্য আশা, নন্দীগ্রামের নিখোঁজদের পরিজনেরা ‘ন্যায়বিচার’ পাবেন। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রতিক্রিয়া, “রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র চলছে। মিথ্যা মামলায় আমাদের দলের নেতাদের ফাঁসানো হয়েছে, প্রথম থেকেই বলে আসছি। অভিযোগের পক্ষে নির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে না-পারলেও রাজ্য সরকার লক্ষ্মণবাবুর জামিনের আবেদনের বারেবারে বিরোধিতা করেছে। শেষ পর্যন্ত তাঁর জামিন হয়েছে। রাজ্য সরকারের বোঝা উচিত, এই ভাবে কাউকে চিরদিন আটকে রাখা যায় না! সুশান্ত ঘোষের সময়েও আমরা এই কথা বলেছিলাম, এখনও বলছি।” নন্দীগ্রামে ‘অপারেশন সূর্যোদয়ে’র সময় নিখোঁজদের মামলায় বাম আমলে কারও যে শাস্তি হয়নি, সেই প্রসঙ্গে সূর্যবাবুর বক্তব্য, “তদন্ত হয়েছিল, চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল, মামলা চলছিল। তার পরে নতুন সরকার তাদের মতো কাজ করছে।” সিপিএমের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তৃণমূলের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শিশির অধিকারীর প্রশ্ন, “হাইকোর্ট সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পালিয়েছিলেন লক্ষ্মণবাবুরা! যদি নির্দোষই হবেন, তবে তিনি এত দিন পালিয়ে ছিলেন কেন?” তাঁর মন্তব্য, “নন্দীগ্রামের নিখোঁজদের পরিজনেরা বিচার চাইছেন। আশা করি, নিশ্চয়ই ন্যায়বিচার হবে। কঠোর সাজা হবে দোষীদের।” নন্দীগ্রামের ওই নিখোঁজদের খুন করে তাঁদের দেহ লোপাট করা হয়েছিল বলেই ইতিমধ্যে চার্জশিটে জানিয়েছে সিআইডি। ঘটনাচক্রে, এ দিনই নন্দীগ্রামে এক বৈঠকে তৃণমূল নিয়ন্ত্রিত ভূমি-উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির এক বৈঠকে আগামী ১৮ তারিখ, বুধবার নন্দীগ্রাম বাসস্ট্যান্ডে নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে ‘দোষীদের শাস্তির দাবি’তে সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে।
শুধুমাত্র ‘ষড়যন্ত্রে’র অভিযোগে কোনও ব্যক্তিকে এত দিন আটকে রাখা যায় না বলে লক্ষ্মণবাবুর জামিনের আবেদন জানিয়ে হাইকোর্টে সওয়াল করেছিলেন আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য। ওই মামলার চার্জশিটও পেশ হয়ে গিয়েছে বলে ডিভিশন বেঞ্চকে জানিয়েছিলেন বিকাশবাবু। এই মামলার শুনানির সময় এ দিন সিআইডি-র কাছে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চায় ডিভিশন বেঞ্চ। সরকারি আইনজীবী জানান, সিআইডি এখন ওই সময়ে পুলিশের ভুমিকা নিয়ে তদন্ত করছে। লক্ষ্মণবাবু সম্পর্কে আর নতুন কোনও ‘অগ্রগতি’র কথা পুলিশ জানাতে পারেনি। এর পরেই শর্তাধীনে লক্ষ্মণবাবুর জামিন মঞ্জুর করে ডিভিশন বেঞ্চ। |
নন্দীগ্রাম নিখোঁজ-কাণ্ড |
৬-১০ নভেম্বর ২০০৭: নন্দীগ্রাম ‘পুনর্দখলে’ সিপিএমের ‘সূর্যোদয় অভিযান’, ভূমি-উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির মিছিলে হামলার অভিযোগ।
রেজাউল ইসলাম, শ্যামলী মান্না, হরেন প্রামাণিকের
দেহ উদ্ধার, নিখোঁজ ৬, সিপিএম নেতা তপন-সুকুর ধৃত।
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১১: ‘নিখোঁজ’দের পরিজনদের ‘হেবিয়াস কর্পাস’ আবেদনে সিআইডি-তদন্তের
নির্দেশ হাইকোর্টের
৩০ জানুয়ারি ২০১২: লক্ষ্মণ শেঠ-সহ ৮৮ সিপিএম নেতা-কর্মীর নামে চার্জশিট। সিআইডি জানাল, নিখোঁজদের খুন করে দেহ লোপাট করা হয়েছে।
২৭ ফেব্রুয়ারি: ফেরারদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা।
১৭ মার্চ: মুম্বই থেকে ধৃত লক্ষ্মণ শেঠ, অমিয় সাউ, অশোক গুড়িয়া।
৩ জুন: হলদিয়া পুরসভা ভোটে তমালিকা পণ্ডাশেঠের নেতৃত্বে বামেদেরই জয়।
২৬ জুন: লক্ষ্মণ শেঠ হলদিয়া থেকে আলিপুর জেলে।
১৩ জুলাই: হাইকোর্টে জামিন মঞ্জুর লক্ষ্মণ শেঠের। |
|
তবে জামিনের ‘শর্ত’ আপত্তিকর বলে মন্তব্য করেছেন লক্ষ্মণ-জায়া তমালিকা পণ্ডা শেঠ এবং সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। হলদিয়ার পুরপ্রধান এবং সিপিএমের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তমালিকাদেবীর বক্তব্য, “উনি এই জেলায় ঢুকতে পারবেন না বলে যে শর্ত দেওয়া হয়েছে, তা আপত্তিকর। তেমন হলে এই শর্ত প্রত্যাহারের জন্যও আইনি পদক্ষেপ করা হবে।” তাঁর দাবি, “আগাগোড়াই সাজানো মামলা। এখন জামিন হয়েছে। আমরা নিশ্চিত, মামলা থেকেও নির্দোষ হিসাবে খালাস পাবেন সবাই।” বিমানবাবুও মধ্যমগ্রামে বামফ্রন্টের কর্মিসভায় যোগ দিতে গিয়ে ‘মিথ্যা মামলা’র কথা উল্লেখ করে বলেছেন, “ওঁকে অদ্ভুত কিছু শর্তসাপেক্ষে জামিন দেওয়া হয়েছে। যেমন, ওঁকে সপ্তাহে দু’ দিন সিআইডি-র সঙ্গে দেখা করতে হবে। উনি জেলায় যেতে পারবেন না। এক জন রাজনৈতিক নেতার পক্ষে এ রকম শর্ত নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো সমস্যা।”
প্রাক্তন সাংসদের জামিনের খবরের পর তমালিকাদেবী এ দিন বলেছেন, “আমি পার্টি-কর্মী। শুধু লক্ষ্মণবাবুর স্ত্রী নই। ওঁর মতোই শাসক দলের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে এই মামলায় আমাদের দলের আরও যাঁরা বন্দি আছেন, তাঁদের প্রত্যেকের মুক্তির জন্যে লড়াই চলবে।” প্রসঙ্গত, এই মামলায় এখনও জেলে রয়েছেন ১১ জন সিপিএম নেতা-কর্মী। তাঁদের অন্যতম প্রাক্তন বিধায়ক অমিয় সাউ এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কৃষকসভার সম্পাদক অশোক গুড়িয়া। মামলায় মোট অভিযুক্ত ৮৮ জন। আগেই জামিন পেয়েছেন ৮ জন। এক জন মৃত। ‘ফেরার’ বাকি ৬৭ জনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের জন্যে ইতিমধ্যে হলদিয়া আদালতে আবেদন করেছে সিআইডি। চার্জশিট পেশের কয়েক মাস আগে থেকেই আত্মগোপনে যাওয়া লক্ষ্মণবাবুকে মুম্বই থেকে গ্রেফতার করে সিআইডি।
হলদিয়া সাব-জেল থেকে গত ২৬ জুন তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল-জেলে। |
নন্দীগ্রাম নিখোঁজকাণ্ডে জামিন লক্ষ্মণ শেঠের |
সবাই নির্দোষ প্রমাণ হবেন |
এই যে উনি (লক্ষ্মণ শেঠ) জেলায় ঢুকতে পারবেন নাএটা আপত্তিকর। তেমন হলে এই শর্ত প্রত্যাহারের জন্যেও আইনি পদক্ষেপ করা হবে। আগাগোড়াই তো সাজানো মামলা। এখন জামিন হয়েছে, আমরা নিশ্চিত--মামলা থেকেও নির্দোষ হিসাবে খালাস পাবেন সবাই। আমি পার্টি-কর্মী। শুধু লক্ষ্মণবাবুর স্ত্রী নই। ওঁর মতোই শাসকদলের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে এই মামলায় আমাদের দলের আরও যাঁরা জেলবন্দি হয়ে আছেনতাঁদের প্রত্যেকের মুক্তির জন্যে লড়াই চলবে। |
|
ন্যায়বিচার চাইছে নন্দীগ্রাম |
|
তমালিকা পণ্ডাশেঠ |
নন্দীগ্রামে সিপিএমের সন্ত্রাসে নিখোঁজদের পরিজনেরাই হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। হাইকোর্ট সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিতেই পালিয়েছিলেন লক্ষ্মণবাবুরা। যদি নির্দোষই হবেন লুকিয়ে ছিলেন কেন? ওঁদের ধরতে সেই মুম্বইয়ে যেতে হয়েছিল সিআইডিকে। জামিন পেয়েছেন মাত্র। কিন্তু মামলা চলবে। নন্দীগ্রামের ওই নিখোঁজদের খুন করে দেহ লোপাট করা হয়েছে বলে চার্জশিটে জানিয়েছে সিআইডি। নিখোঁজদের পরিজনেরা বিচার চান। আশা করি, নিশ্চয়ই ন্যায়বিচার হবে। |
|
প্রসঙ্গত |
|
শিশির অধিকারী |
এই মামলায় এখনও জেলে রয়েছেন ১১ জন সিপিএম নেতা-কর্মী। তাঁদের অন্যতম পূর্ব পাঁশকুড়ার প্রাক্তন বিধায়ক অমিয় সাউ এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কৃষকসভার সম্পাদক অশোক গুড়িয়া। মামলায় অভিযুক্ত ৮৮ জন। আগেই জামিন পেয়েছেন ৮ জন (লক্ষ্মণবাবুকে নিয়ে ৯)। এক জন মৃত। ‘ফেরার’ বাকি ৬৭ জনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের জন্যে হলদিয়া আদালতে আবেদন করেছে সিআইডি (ফেরারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: খেজুরির নেতা হিমাংশু দাস, বিজন রায়, প্রজাপতি দাস, রবিউল হোসেন এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার সিপিএম নেতা তপন ঘোষ ও সুকুর আলি)। আগামী সোমবারই রয়েছে সেই আবেদনের শুনানি। আবার দোষীদের শাস্তির দাবিতে আগামী বুধবার নন্দীগ্রামে সমাবেশের ডাক দিয়েছে ভূমি-উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি।
|
২০০৭-এর ১০ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ ভূমি-কমিটির সদস্য গোকুলনগরের আদিত্য বেরা, সাউদখালির ভগীরথ মাইতি, বলরাম সিংহ ও সত্যেন গোল, সোনাচূড়ার নারায়ণ দাস ও সুবল মাজি। ২০১২-র ৩০ জানুয়ারি ৮৮ জন সিপিএম নেতা-কর্মীকে অভিযুক্ত করে হলদিয়া আদালতে পেশ করা চার্জশিটে সিআইডি জানিয়েছে, নিখোঁজেরা খুনই হয়েছেন। লোপাট করা হয়েছে তাঁদের দেহ। ১৩৮ জনের জবানবন্দি-র ভিত্তিতে ২১৫ পাতার চার্জশিট পেশ করা হয় বেআইনি জমায়েত (ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৭ ধারা), অবৈধ আটক (৩৪২), রাহাজানি (৩৯১), মারধর (৩২৩), অপহরণ (৩৬৪), খুনের ষড়যন্ত্র (১২০ বি), খুনের চেষ্টা (৩০৭), খুন (৩০২), তথ্যপ্রমাণ লোপ (২০১), সম্মিলিত অভিপ্রায় (৩৪) এবং আগ্নেয়াস্ত্র বহনের (২৫ ও ২৭ অস্ত্র আইন) ধারায়। |
|
|
|
|
|
|