|
|
|
|
ক্যামেরার সামনে ৩০ মিনিট ধরে নিগ্রহ ছাত্রীর |
রাজীবাক্ষ রক্ষিত • গুয়াহাটি |
শহরের মাঝখানে বিরাট হোর্ডিং। তাতে জনা কয়েক যুবকের মুখ।
শহর তাদের খুঁজছে। খুঁজছে গোটা দেশ।
এই যুবকেরা সেই ২০-৩০ জনের মধ্যে ছিল। যে ২০-৩০ জন সোমবার রাত দশটার সময় গুয়াহাটি-শিলং রোডের উপরে প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে নিগ্রহ করছিল এক কিশোরীকে। কখনও তার চুল টেনে ধরে রাস্তায় বসাচ্ছিল, কখনও টেনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিল। চড়-থাপ্পড় মারছিল। ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে তার পোশাক টেনে খুলে দেওয়ার চেষ্টা করছিল।
ক্যামেরা রোল হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরাম্যান নিজেই মেয়েটির মুখ থেকে চুল সরিয়ে দিচ্ছেন! যাতে আরও ভাল করে দেখা যায় তাকে! সংবাদমাধ্যমের কর্মী, পথচলতি জনতা, পাশ দিয়ে চলে যাওয়া একের পর এক গাড়ির যাত্রী সকলেই দেখলেন। অনেকে মোবাইলে ছবি তুলে রাখলেন। আধ ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরে পুলিশ এসে মেয়েটিকে উদ্ধার করার আগে কাউকেই সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে দেখা গেল না। পুলিশও মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেল! ঘটনাস্থল থেকে কাউকে গ্রেফতার করা হল না! একাদশ শ্রেণির ছাত্রী ওই কিশোরীর নাম-ধামও গোপন রাখা হল না। “লজ্জায় আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছিল। তবে এখন আমি পাল্টা লড়াই করতে তৈরি,” ঘটনার চার দিন পর আজ মুখ খুলল মেয়েটি। |
|
খোঁজ চাই ওদের। ছাত্রী-নিগ্রহে অভিযুক্তদের ছবি দিয়ে গুয়াহাটির রাস্তায় হোর্ডিং। উজ্জ্বল দেবের তোলা ছবি। |
সোমবার রাতের ঘটনা। প্রথম গ্রেফতারটি হয়েছে বৃহস্পতিবার। মাঝের ক’দিনে ঘটনার ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়েছে স্থানীয় টিভি চ্যানেলে। সেখান থেকে ক্লিপ ছড়িয়েছে ইন্টারনেটে। আজ দিনভর জাতীয় সংবাদমাধ্যম তোলপাড় তুলল ওই ক্লিপ নিয়ে। তখন দিল্লি থেকে অসম প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে উঠলেন। পুলিশের ভূমিকা, সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সব রকম সম্ভাব্য প্রশ্ন উঠে এল। জাতীয় মহিলা কমিশন থেকে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন, মুখ্যমন্ত্রী থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কংগ্রেস-বিজেপি-বামের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সবাই ঘটনার নিন্দায় মুখর হলেন। উপযুক্ত ব্যবস্থা এবং তদন্ত হবে বলে আশ্বাস দিল পুলিশ। ডিজিপি জয়ন্ত চৌধুরি জানালেন, মোট ১২ জনকে শনাক্ত করা গিয়েছে। তার মধ্যে চার জন ধরা পড়েছে। বাকিরাও ধরা পড়বে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
ঠিক কী ঘটেছিল ৯ জুলাই রাতে? কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার স্মৃতিই খানিকটা উস্কে দিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, রাত ১০টা নাগাদ গুয়াহাটি-শিলং রোডের ধারে একটি পানশালা থেকে বার হয় দুই কিশোরী। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়ি থেকে দুই যুবক ওই কিশোরীদের উদ্দেশে কটূক্তি করলে তারা প্রতিবাদ জানায়। সেই থেকে শুরু হয় বাদানুবাদ। পুলিশের বয়ান অবশ্য খানিকটা আলাদা। তাদের বক্তব্য, মেয়ে দু’টি আরও চার জন ছেলের সঙ্গে পানশালায় ঢুকেছিল। সেখানে নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে তারা। পানশালা থেকে তাদের বার করে দেওয়া হয়। তখন তারা রাস্তার উপরে ঝগড়া করতে থাকে। উপস্থিত জনতা তাদের থামানোর চেষ্টা করতেই এগিয়েছিল। ‘তার পর পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়।’ এ দিন নিগৃহীতা মেয়েটি নিজে অবশ্য দাবি করে, “এমন কিছু মত্ত ছিলাম না। আমার কি বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে গিয়ে মজা করার অধিকার নেই?”
এর পাশাপাশি আরও একটি গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। যে সাংবাদিক ভিডিও তোলা শুরু করেন, ঘটনার সূত্রপাত করার জন্য তাঁর দিকেই আঙুল উঠছে। কৃষক নেতা অখিল গগৈ এ দিন সরাসরি ওই সাংবাদিকের নাম করে বলেন, “আমাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে, পানশালার সামনে গাড়িতে মদ্যপানরত অবস্থায় ওই সাংবাদিক ও তার সঙ্গীই মেয়েটিকে টানাটানি শুরু করেছিলেন। ক্ষিপ্ত মেয়েটি ওই সাংবাদিককে মারলে তিনি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য স্থানীয় যুবকদের খেপিয়ে তুলে ছবি তুলতে শুরু করেন।”
অসমের ডিজি সে কথা না বললেও সংবাদমাধ্যমের প্রতি তাঁর অভিযোগ, অত্যাচারের ছবি আধ ঘণ্টা ধরে না তুলে সাংবাদিকদের উচিত ছিল মেয়েটিকে বাঁচানো। মেয়েটির নিজের কথায়, “কী যে অসহায় লাগছিল তখন! মনে হচ্ছিল, এরা কি মানুষ? কেউ আমায় সাহায্য করছে না। উল্টে ছবি তুলে যাচ্ছে!” |
|
সংশ্লিষ্ট চ্যানেলের কী বক্তব্য? চ্যানেলের প্রধান সম্পাদক অতনু ভুঁইঞার দাবি, অখিল গগৈয়ের অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। ডিজি-র কথার নিরিখে তাঁর জবাব, “ছেলেমেয়েরা মারপিট করছে দেখে এক সাংবাদিক প্রথমে মোবাইলে ছবি তোলেন। পরে দফতর থেকে দুই ক্যামেরাম্যান ঘটনাস্থলে যান। ওই তিন জনের পক্ষে ২০ জন যুবককে সামলানো সম্ভব ছিল না।” বস্তুত এ জাতীয় ঘটনার সামনে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধির ভূমিকা কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে বিতর্ক বহু পুরনো। ১৯৬০ সালে জাপানের সোশ্যালিস্ট নেতা ইনেজিরো আসানুমা টিভি ক্যামেরার সামনে বক্তৃতা দিতে দিতেই খুন হয়ে যান। তখনও প্রশ্ন উঠেছিল, সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা ছবি না-তুলে ছুটে গেলেন না কেন! গুয়াহাটির ঘটনার ক্ষেত্রে প্রধান সম্পাদক অতনু এবং সম্পাদক জারির হুসেন, দু’জনেরই বক্তব্যের নির্যাস ছবি তোলা সাংবাদিকের কাজ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা পুলিশের কাজ। ওঁদের দাবি, “ছবি উঠেছে বলেই অপরাধীরা ধরা পড়েছে।”
রুবুল দাস, বিকাশ তিওয়ারি, মহম্মদ হাফিজুদ্দিন এবং ধনরাজ বাসফোর চার জন ধরা পড়েছে ঠিকই। কিন্তু পুলিশের ভূমিকাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। ঘটনাস্থল থেকে কাউকে ধরা হল না কেন, ছবি থাকা সত্ত্বেও প্রথম গ্রেফতারটি করতে তিন দিন পেরিয়ে গেল কেন, চার দিন পরেও মাত্র চার জন গ্রেফতার কেন অভিযোগ বহু। অমরজ্যোতি কলিতা নামে এক যুবক শনাক্ত হয়েছে, তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে অসম বিদ্যুৎ সংস্থা। কিন্তু সে তবু ধরা পড়েনি।
খবর পাওয়ার পরে পুলিশ সে দিন ঘটনাস্থলে পৌঁছতে দেরি করেছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ডিজি জয়ন্ত চৌধুরি এ দিন তার উত্তর দিতে গিয়ে বলেন, “পুলিশ তো আর এটিএম মেশিন নয়!” পরে তাঁর এই মন্তব্য নিয়ে মুখ খোলেন খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। চণ্ডীগড়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, “ওঁরা যদি ঘটনাটাকে হাল্কা করে দেখানোর চেষ্টা করেন, আমি তার তীব্র নিন্দা করছি।” অসমের আরও এক পুলিশকর্তাও জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে হইচইয়ের সাপেক্ষে বলেছেন, “দিল্লির এত কথা বলা সাজে না। উত্তর-পূর্বের মেয়েদের কাছে দিল্লি শহরটা ধর্ষণের রাজধানী!” চিদম্বরম এই কথারও প্রতিবাদ করেন।
পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে কাল শহরে আসছেন জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন মমতা শর্মা। রাজ্যের মুখ্যসচিব এমিলি চৌধুরির নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। তিনি বলেছেন, “অপরাধীদের ছবি হাতে থাকা সত্ত্বেও তাদের ধরতে এত দেরি হচ্ছে কেন, পুলিশের কাছে জবাব চেয়েছি।” রাজ্য মানবাধিকার কমিশনও তদন্ত শুরু করেছে। রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন মীরা বরুয়া বলেন, “দু’দিন আগেই মামলা দায়ের করেছি। কিন্তু মেয়েটি জবানবন্দি দিতে রাজি হয়নি।” আজ জরুরি ভিত্তিতে পানশালা মালিকদের বৈঠকে ডাকা হয়। কামরূপের জেলাশাসক আশুতোষ অগ্নিহোত্রী জানান, রাত ১০টার পর পানশালা খোলা রাখা যাবে না। পানশালায় ঢুকতে এ বার থেকে বয়সের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। |
|
|
|
|
|