সরকারি হাসপাতালে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের অবাধ যাতায়াত রুখতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশকে কার্যত ‘থোড়াই কেয়ার’ করার অভিযোগ উঠল রাজ্যের সব চেয়ে বড় সরকারি হাসপাতালের এক নামী হৃদ্রোগ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। তাঁর বিভাগে ওই প্রতিনিধিদের ঢালাও ছাড়পত্র দেওয়ার পাশাপাশি বিষয়টিকে ‘বৈধ’ করার জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদনও চেয়েছেন তিনি।
স্বভাবতই এর মধ্যে কোনও ‘চক্র’ রয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি যা করছেন, তার সবটাই ‘সুচিকিৎসা’র স্বার্থে।
বিষয়টি শোরগোল ফেলেছে স্বাস্থ্য দফতরেও। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, চিকিৎসকদের এই আচরণ পুরোপুরি বেআইনি। বিষয়টির তদন্ত হবে।
সরকারি হাসপাতালে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের অবাধ যাতায়াত নিয়ে অভিযোগ বহু দিনের। শুধু আউটডোর নয়, ইন্ডোর, এমনকী অপারেশন থিয়েটারের ভিতরেও ঘুরতে দেখা যায় তাঁদের। সরকারি তরফে হাজারো সার্কুলার সত্ত্বেও বিষয়টি বন্ধ করা যায়নি। সম্প্রতি এসএসকেএম হাসপাতালের ‘ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিওভাস্কুলার সায়েন্সেস’-এর অধিকর্তা অরূপ দাস বিশ্বাস ১১টি সংস্থার ১৫ জন প্রতিনিধির নামের তালিকা হাসপাতাল কতৃর্পক্ষের কাছে পাঠিয়ে তাঁদের হাসপাতালের ভিতরে নিজেদের সরঞ্জাম ‘প্রোমোট’ করার অনুমতি চান। হাসপাতাল সূত্রের খবর, অরূপবাবুর চিঠি পাওয়ার পরে সুপার তমালকান্তি ঘোষ তাতে একটি নোট লিখে সেটি অরূপবাবুর কাছেই ফেরত পাঠান। নোটে লেখা ছিল, বিষয়টির সঙ্গে রোগীর স্বার্থ কী ভাবে জড়িত, তা বোধগম্য হচ্ছে না। এর পাল্টা অরূপবাবু লেখেন, যেহেতু পেসমেকার, স্টেন্ট, বেলুন ইত্যাদি হাসপাতাল থেকে সরবরাহ হয় না, তাই ওই সংস্থার প্রতিনিধিদের হাসপাতালে উপস্থিত থাকা জরুরি। কারণ, তাঁরাই রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী সরঞ্জাম সরবরাহ করেন।
সুপারকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “অপারেশন থিয়েটারের বাইরে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের ভিড় দেখলে বহু সময়েই নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের বার করে দেন। কিন্তু তার পরেও সমস্যা কমে না। এখন সার্কুলার জারি করেছি দুপুর দু’টোর আগে কাউকে যেন আউটডোর বা ওটির বাইরে দেখা না যায়। সকলে নীচে অপেক্ষা করবেন, কাউকে প্রয়োজন হলে ডেকে পাঠানো হবে।”
ওটির বাইরে দাঁড়ানোর পরিবর্তে নীচে অপেক্ষা করতে বলে কার্যত কি পরিস্থিতির সঙ্গে আপস করা হচ্ছে না? কথাটা মেনে নিয়ে সুপার বলেন, “হাসপাতালের নিজস্ব ‘ফেয়ার প্রাইস শপ’ খোলার চেষ্টা চলছে। তা হলে সেখান থেকেই সরঞ্জাম কেনা যাবে। তখন আর এমন করতে হবে না।”
কেন কর্তৃপক্ষ ‘আপসে’ বাধ্য হচ্ছেন, তার-ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন এক কর্তা। তাঁর অভিযোগ, কার্ডিওলজি বিভাগের কয়েক জন চিকিৎসক রোগীর পরিবারের লোকজনকে বুঝিয়েছিলেন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভরা না থাকলে পেসমেকার, স্টেন্ট বসাতে সমস্যায় পড়তে হবে এবং সে জন্য রোগীর ক্ষতি হলে তাঁরা দায়ী থাকবেন না। চলতি সপ্তাহে সরঞ্জাম সরবরাহ আচমকা বন্ধও করে দেয় কয়েকটি সংস্থা। যার জেরে বিপাকে পড়েন রোগীরা। হাসপাতাল সুপারের ঘরের সামনে কিছু রোগীর পরিবারের তরফে বিক্ষোভও দেখানো হয়।
অরূপবাবুর দাবি, ‘চিকিৎসার স্বার্থে’ যেটুকু জরুরি, তিনি সেটাই করেছেন। স্টেন্ট বা পেসমেকারের ক্ষেত্রে কিছু ‘স্পেসিফিকেশন’ মেলাতে হয় বলেই ওটির আশপাশে সংস্থার প্রতিনিধিদের থাকা দরকার বলেও জানান তিনি। কিন্তু কোনও রোগীর বাড়ির লোক ওই সংস্থার কাছ থেকে না কিনতে চাইলে বা অন্য কোনও সংস্থার কাছ থেকে ওই সরঞ্জাম আরও কম দামে পাওয়ার ব্যবস্থা করলে, কেন তা করা যাবে না? কেন চিকিৎসকদের একাংশের ‘পছন্দ’ করা সংস্থার সরঞ্জামই কিনতে বাধ্য থাকবেন তাঁরা? সেই প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া যায়নি।
শুধু চিকিৎসক-ওষুধ সংস্থার আঁতাতই নয়, অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে বহিরাগতদের এমন অবাধ প্রবেশ রোগীর সংক্রমণের কারণ হয়ে উঠতে পারে না কি? বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, সেই আশঙ্কা পুরোমাত্রায় রয়েছে। তবুও কী ভাবে দিনের পর দিন এটা হয়ে চলেছে, তার ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেননি। |