অগ্নিকন্যা ও এক অর্জুন।
ঝোড়ো হাওয়া বইছে, সবুজ ঘাসের উপর নেমে আসছে বৃষ্টির ফোঁটা। ৭০ মিটার দূরের ‘টার্গেট’টা কারও কারও সামনে আবছা হয়ে আসছে। কিন্তু তাঁদের কাছে নয়। ধনুক থেকে ছিটকে বেরোনো প্রতিটা তিরেই যেন লেখা থাকছে একটা ঠিকানা: অলিম্পিক পদক।
ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে আসছিল দুটো চেহারা। এক জন ছোটখাটো, ছিপছিপে, শ্যামবর্ণা। অন্য জন লম্বা, দোহারা, এলো চুল। সে দিকে তাকিয়ে লিম্বা রাম যেন বারবার অতীতে ফিরে যাচ্ছিলেন, “আমি পারিনি। কিন্তু দেখবেন এরা পারবে। পদক আনবে। আমার সে বিশ্বাস আছে।”
দীপিকা কুমারী এবং রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়।
এক জন মেয়েদের তিরন্দাজিতে এই মুহূর্তে বিশ্বের এক নম্বর। লন্ডন অলিম্পিক থেকে ব্যক্তিগত ইভেন্টে সোনা জেতার ব্যাপারে ভারতের সেরা বাজি। অন্য জন বাংলার একান্ত আপন, যাঁকে ঘিরে বাঙালিরা স্বপ্ন দেখতে পারেন একটি অলিম্পিক পদকের।
দীপিকার সঙ্গে কথা বললে একটা মিষ্টি, লাজুক, শান্ত স্বভাবের মেয়ের ছবি সামনে ভেসে উঠবে। কিন্তু সেই ছবিটাই বদলে যায় হাতে ধনুক উঠে এলে। আঠারো বছরের মেয়েটি তখন যেন এক ভয়ডরহীন অগ্নিকন্যা। “ও একবার এরিনায় নেমে পড়লে কাউকে ভয় পায় না,” মত দুই কোচ লিম্বা এবং পূর্ণিমা মাহাতোর। আর দীপিকা কী বলছেন? “ভয়? না আমি পাই না। আর চাপ নিয়ে মাথাও ঘামাই না। আমার মাথায় তখন খালি টার্গেটটা ঘোরে,” বৃহস্পতিবার সল্ট লেক সাইয়ে প্র্যাক্টিস শেষে বলছিলেন দীপিকা। |
ঝাড়খণ্ডের মেয়ে। বাবা অটো রিকশা চালক। মা রাঁচির সরকারি হাসপাতালের নার্স। ছোট থেকে লড়াই করে উঠে আসা মেয়েটির চোখে আগুন জ্বলে উঠল অলিম্পিকের কথা ওঠা মাত্রই, “অলিম্পিক পদক...যখন থেকে তির ধনুক হাতে নিয়েছি, একটা স্বপ্নই দেখেছি...অলিম্পিক পদক। এক নম্বর র্যাঙ্কিংটা আমার কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু ওই পদকের মূল্যই আলাদা।”
ঝাড়খণ্ড যখন, তুলনা একটা উঠবেই। উঠলও। এবং আবার দেখা গেল চোয়াল চাপা একটা সংকল্প। “জানি, ধোনি আর ক্রিকেটকেই ঝাড়খণ্ডে সবাই চেনে। কেন? কারণ ক্রিকেটে বিশ্বকাপ এসেছে। আমাকেও সবাই চিনে যাবে যদি অলিম্পিক পদকটা আসে।”
রাহুল আবার নিজের স্বপ্নটা তিলতিল করে গড়ে তুলেছেন দিদি দোলা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে। “দিদি যখন সোনা জিতত, জাতীয় সঙ্গীত বাজত...মনে হত, আমাকেও এক দিন এ রকম হতে হবে,” বলছিলেন গত বছর অর্জুন পুরস্কার পাওয়া বাংলার তিরন্দাজ।
লন্ডনে কি তিনি অলিম্পিকের ‘অর্জুন’ হয়ে উঠতে পারবেন? নিজের ফর্ম ঠিক সময় ‘পিক’ করছে, দলেরও। তাই অন্তত পুরুষদের দলগত ইভেন্টে একটা পদক অনেকেই দেখতে পাচ্ছেন।
রাহুলের একটাই চিন্তা। লন্ডনের আবহাওয়া। “স্টেডিয়ামে হাওয়া ঘুরপাক খাবে। সেই মতো মানিয়ে নিতে হবে। বৃষ্টিটা নিয়েও চিন্তা আছে। বৃষ্টিতে যদি টার্গেট দেখা না যায়, এক মাত্র তা হলেই ইভেন্ট বন্ধ হবে। না হলে ওই অবস্থায়ও চলবে।” দশ দিন আগে তিরন্দাজি দল পৌঁছচ্ছে লন্ডন। লর্ডসে ক্রিকেট সরিয়ে এই প্রথম অলিম্পিক তিরন্দাজির আসর। ওই দশটা দিন রাহুলরা পাবেন লর্ডসের হাওয়া আর ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে।
আর একটা ফ্যাক্টরও থাকছে। দর্শক। ১০-১৫ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দীপিকাকে দেখিয়ে রাহুল বলছিলেন, “প্রায় ওই সব জায়গায় দর্শক এসে দাঁড়াবে। একদম ঘাড়ের উপর। প্রচুর আওয়াজ হবে, ব্যারাকিং হবে।”
কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন। চ্যালেঞ্জ আসতে পারে এদের থেকেই। “কিন্তু আমরাও পুরোপুরি তৈরি,” বলছিলেন এক কালে স্বপ্ন দেখানো সেই লিম্বা। টিম ইভেন্টে রাহুলের দুই সঙ্গী জয়ন্ত তালুকদার, তরুণদীপ রাই। দীপিকার সঙ্গী হবেন বোম্বাইলা দেবী, চেকরোভোলু সুওরো। ব্যক্তিগত ইভেন্টেও লড়বেন এঁরা।
১৯৮৩-র লর্ডস ভারতীয় ক্রিকেটের নবজন্ম দেখেছিল কপিল দেবদের হাত ধরে। ২০১২-র লর্ডসে কী অপেক্ষা করে আছে? ২৫ জুন লর্ডসের ব্যালকনিতে কপিলের হাত তুলে ধরেছিলেন গাওস্কর।
আসন্ন অগস্টে ‘অগ্নিকন্যা’ আর ‘অর্জুন’ কি হাতে হাত মিলিয়ে বলতে পারবেন, “আমরা পেরেছি”?
|