মায়ানমারে নির্বাচিত পার্লামেন্টের অধিবেশনে বিরোধী নেত্রী আঙ সান সু চি ও তাঁহার দলীয় সাংসদরা যোগ দিয়াছেন। সামরিক শাসনের মধ্যেই গণতান্ত্রিক নিরীক্ষার সংকীর্ণ পরিসরটি অতঃপর ক্রমশ সম্প্রসারিত করার চেষ্টা চলিবে। সেই প্রক্রিয়াতেই একটি মাইলফলক হইয়া থাকিতে পারে মায়ানমারের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এত কালের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত। প্রেসিডেন্ট ওবামা ঘোষণা করিয়াছেন, মায়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কারের গতি ত্বরান্বিত করিতেই তাহার বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার জরুরি, কেননা ইহার ফলে সে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলিতে মার্কিন লগ্নিকারীদের বিনিয়োগের পথ মসৃণ হইবে। সু চি-ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণাকে স্বাগত জানাইয়াছেন।
ইতিপূর্বেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রিটেন মায়ানমারের বিরুদ্ধে তাহাদের অর্থনৈতিক অবরোধ শিথিল করার সিদ্ধান্ত লইয়াছে। কৃতজ্ঞ সু চি তাঁহার বিদেশ সফরের তালিকায় ব্রিটেন ও ইউরোপকে অন্তর্ভুক্ত করিয়া তাহার প্রতিদানও দিয়াছেন। ওই সব দেশের লগ্নিকারী সংস্থাগুলি মায়ানমারের সমৃদ্ধ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্ভার দখলে লইতে মরিয়া। মার্কিন লগ্নিকারীদের সহিত এই ক্ষেত্রে তাহাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাও শুরু হইবে। এই প্রতিযোগিতা মায়ানমারের দুঃস্থ অর্থনীতির পক্ষে উপযোগী সাব্যস্ত হইতে পারে। তাই সু চি-র মতো জননেত্রী পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলির এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাইয়াছেন। একই সঙ্গে একটি বিপদের আশঙ্কাও রহিয়াছে। মায়ানমারের অনেক কোম্পানিই সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা সেগুলির মালিক। ওই সব সংস্থায় বিপুল অঙ্কের বিদেশি বিনিয়োগ নিকট কিংবা দূর ভবিষ্যতে মায়ানমারে একটি মুৎসুদ্দি ধনিক শ্রেণি ও তাহার নিয়ন্ত্রিত নয়া-উপনিবেশবাদী অর্থনীতি বিকশিত করিয়া তুলিতে পারে। সে ক্ষেত্রে ওই ধরনের বিনিয়োগ ও আর্থিক ‘সহযোগিতা’ মুষ্টিমেয় কিছু ক্ষমতাবানের ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধি করিবে। এ জন্যই মায়ানমারের অর্থনীতিতে পশ্চিমী লগ্নিকে স্বাগত জানাইয়াও সু চি কিছু সতর্কতা অবলম্বনের কথাও বলিয়াছেন।
সু চি-র আপাতত পরামর্শ, বিদেশি বিনিয়োগ ও সহযোগিতা ‘স্বচ্ছ’ হউক। এই সহযোগিতার মধ্যে কোনও গোপনীয়তা, বিদেশি লগ্নিকারীর সহিত দেশীয় সংস্থার পরিচালকদের কোনও গোপন বোঝাপড়া, অনিয়ম থাকা উচিত হইবে না। সু চি সঙ্গত ভাবেই সকলকে স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যে, গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রক্রিয়া সূচিত হইলেও এখনও তাহা বহুলাংশে অসমাপ্ত, জেনারেলরা এখনও প্রভূত সাংবিধানিক ক্ষমতার অধিকারী, নির্বাচিত সংস্থা হিসাবে পার্লামেন্ট এখনও সার্বভৌম নয়। এই অবস্থায় পশ্চিমী গণতন্ত্রগুলির ‘কাছা-খোলা’ হইয়া মায়ানমারে বিনিয়োগ করিতে দৌড়াইয়া আসার প্রয়োজন নাই, ধীরে-সুস্থে, দেখিয়া-শুনিয়া অগ্রসর হওয়া ভাল। বর্তমান প্রেসিডেন্ট থাইন সেইন সংস্কার-প্রক্রিয়া শুরু করিয়াছেন। কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি। যে জেনারেলরা এত কাল নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করিয়া আসিয়াছেন, সংস্কারের গতি তীব্রতর ও অপরিবর্তনীয় হইলে তাঁহারা কত দূর তাহা বরদাস্ত করিবেন, বলা কঠিন। সংস্কারের জন্য চাপ অতএব শাসক গোষ্ঠীর উপর রাখিয়া যাইতেই হইবে। মনে হয়, সু চি-র সংশয় অমূলক নয়। অন্য যে কাহারও চেয়ে তিনি জেনারেলদের ভাল চেনেন। |