|
|
|
|
ব্যক্তি আগে না নীতি, দলে প্রশ্ন সেটাই |
কংগ্রেস নিয়ে এখন দ্বন্দ্ব ‘দুই’ সিপিএমে |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
এ এক অদ্ভুত ‘ঘরেও নহে, পারেও নহে’ পরিস্থিতি!
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ‘ব্যক্তি’ প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিপিএম। আবার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে সিপিএম সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট জানিয়ে দিয়েছেন, উপরাষ্ট্রপতি পদে কোনও ‘কংগ্রেস প্রার্থী’কে সমর্থন করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়।
ঘটনা হল, প্রণববাবুকে সমর্থন করা নিয়ে সিপিএমের মধ্যে নতুন করে মতাদর্শগত বিতর্ক শুরু হয়েছে। কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে, এই প্রশ্নে। এক দিকে সাম্প্রদায়িকতা রুখতে স্বল্প শক্তির কমিউনিস্ট পার্টিকে কংগ্রেসের পাশে রাখার তত্ত্ব, অন্য দিকে, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের নয়া উদার নীতির বিরোধিতা। এই টানাপোড়েনের মধ্যে কংগ্রেস-বিরোধী চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখতে চেন্নাই থেকে কারাট জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী যখন ফোন করেছিলেন, তখন তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, উপরাষ্ট্রপতি পদে অকংগ্রেসি ব্যক্তিকেই সমর্থন করবে তাঁর দল। সিপিএম সূত্র বলছে, হামিদ আনসারি প্রার্থী হলে কারাটদের বাঁচোয়া। আনসারি সেই অর্থে কংগ্রেসের লোক নন। উল্টে কারাটরা বলতে পারবেন, গত নির্বাচনে আনসারি তো তাঁদেরই প্রার্থী ছিলেন।
কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিতর্কটা কিন্তু পিছু ছাড়ছে না।
উপরাষ্ট্রপতি পদে যদি অকংগ্রেসি প্রার্থী দাবি করে সিপিএম, তা হলে কেন রাষ্ট্রপতি পদে কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করা হল? সিপিএম নেতারা বলেছেন, ভারতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রপতি জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগোপাল, একটি নিরপেক্ষ সাংবিধানিক পদ। তাই মূলত কংগ্রেস এবং মমতার সম্পর্কের অবনতিকে কৌশলগত ভাবে উস্কে দিতেই প্রণববাবুকে সমর্থন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকাশ কারাট-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শেষ পলিটব্যুরো বৈঠকে এই বিষয়টিকে মতাদর্শগত বিষয় হিসেবে আমলই দেননি কারাট। যেমনটা দেওয়া হয়েছিল জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রিত্ব বা পরমাণু চুক্তির ক্ষেত্রে।
সমস্যা হল, দলের মধ্যে বহু নেতা এখন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ব্যক্তি যদি প্রধান বিচার্য বিষয় হয়, সরকারি নীতি যদি সেখানে অপ্রাসঙ্গিকই হয়, তবে এনডিএ জমানায় আব্দুল কালামের বিরোধিতা করে লক্ষ্মী সেহগলকে প্রার্থী করার সময় কেন বলা হয়েছিল যে বিজেপি-র প্রার্থীকে আমরা সমর্থন করতে পারি না!
১৯৬৯ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইন্দিরা গাঁধীর প্রার্থী ছিলেন ভি ভি গিরি। কংগ্রেসের ইন্দিরা-বিরোধী ‘সিন্ডিকেটের’ প্রার্থী ছিলেন নীলম সঞ্জীব রেড্ডি। তখন সিপিএম গিরিকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কেন? সিপিএমের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “তখন ইন্দিরা রাজন্য ভাতা বিলোপের কথা বলছেন। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের কথা বলছেন। ‘গরিবি হঠাও’ স্লোগান তুলছেন। সেই পরিস্থিতিতে আমরা মনে করেছিলাম, গিরিকে সমর্থন করলে এ দেশে বামমুখী মতাদর্শ কার্যকর করতে সুবিধা হবে।” প্রশ্ন উঠছে, তা হলে সে দিন ব্যক্তি আগে ছিল, না মতাদর্শ? আবার, ১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাইয়ের আমলে যখন সঞ্জীব রেড্ডি রাষ্ট্রপতি ভোটে ফের প্রার্থী হলেন, তখন কিন্তু তাঁকে সমর্থন করেছিল সিপিএম।
ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি প্রার্থীকে সমর্থন করাটাই যদি দলীয় রণকৌশল হয়, তা হলে অতীতে দল অন্তত তিন বার নিজস্ব প্রার্থী দিয়েছিল কেন, সেই প্রশ্নও উঠছে। সিপিএম নেতারা বুঝতে পারছেন, প্রণববাবুকে সমর্থন করায় প্রসেনজিৎ বসু অথবা জেএনইউ-এর কিছু এসএফআই কর্মীর বিরোধিতা আসলে মূল সমস্যার একটা ছোট বহিঃপ্রকাশ। দলের এক নেতার কথায়, “আসল সমস্যাটা হল, কংগ্রেসকে সমর্থনের প্রশ্নে সেই স্বাধীনতার পর থেকেই দল ধারাবাহিক ভাবে ধারাবাহিকতা-হীনতার পরিচয় দিয়ে চলেছে।”
১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভাঙার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল কংগ্রেস। দল ভাগের পর সিপিএমের মধ্যেও কংগ্রেস নিয়ে দড়ি টানাটানি ঐতিহাসিক। ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ থেকে হরকিষেন সিংহ সুরজিত, সুরজিত থেকে কারাট, সেই বিতর্ক সমানে চলেছে। ১৯৭৭ এবং ১৯৮৯, দু’-দুবার জাতীয় স্তরে অকংগ্রেসি জোট সরকার গঠনের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু এর পর বিজেপি শক্তিসঞ্চয় করলে নতুন করে প্রশ্ন ওঠে, কে বড় শত্রু? বিজেপি না কংগ্রেস? ১৯৯৬ সালে বিজেপি-কে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে গড়া হয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। ১৯৯৮ সালে এনডিএ ক্ষমতায় এলে সিপিএম পার্টি কংগ্রেসের দলিলে বলা হয়, ‘সাম্প্রদায়িকতার শক্তি হল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সন্তান। তাই সাম্প্রদায়িকতা রোখা সব থেকে বড় অগ্রাধিকার। তাই কংগ্রেসের পাশে থাকতে হবে।’ আবার মনমোহন ক্ষমতায় আসার পরে দিল্লি পার্টি কংগ্রেসে কারাট বলেন, “কংগ্রেস এবং বিজেপি থেকে সমদূরত্ব নীতি নিয়ে তৃতীয় বাম বিকল্প গড়ে তোলাই সিপিএমের প্রকৃত লক্ষ্য।”
আর এখন প্রণববাবুকে সমর্থন করে পশ্চিমবঙ্গে কৌশলগত অভীষ্ট পূরণ হচ্ছে বলে মনে করে পলিটব্যুরো। বুদ্ধবাবু তো চিঠি দিয়েই কারাটকে জানিয়েছেন, প্রশ্নটা এখানে নীতির নয়, ব্যক্তির। কারাটের মতো তিনিও প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন, “প্রণববাবুকে সমর্থন করলেও কংগ্রেসের নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চলবে। তবে রাষ্ট্রপতি পদে কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন নতুন নয়। ভি ভি গিরি থেকে কে আর নারায়ণন, প্রতিভা পাটিলকেও সমর্থন করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রপতি পদটা যাতে সাম্প্রদায়িকদের খপ্পরে না পড়ে, সেটাও দেখা দরকার। সেই কারণে কালামেরও বিরোধিতা করা হয়েছে।”
সিপিএম পলিটব্যুরোর সর্বশেষ বৈঠকে কংগ্রেস বিরোধিতার যে তত্ত্বের কথা কেরলের নেতাদের একাট বড় অংশ বলেছিলেন, তা খারিজ করে দিয়ে বাংলার নেতাদের কৌশলের জয় হয়েছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, দলের মধ্যে এই বিতর্ক আরও ঘোরালো হচ্ছে। যার জেরে আজ তামিলনাড়ু রাজ্য কমিটির বৈঠক শেষে কারাট আবার দলে কংগ্রেস বিরোধিতার আগুন উস্কে দিতে চেয়েছেন।
সব দেখে দিল্লির এক সিপিএম নেতার মন্তব্য, “দলের এখন যা অবস্থা তাতে দু’টো সিপিএম হলে ভাল হয়। একটা কংগ্রেসকে সমর্থন করবে, অন্যটা কংগ্রেস বিরোধিতা।” |
|
|
|
|
|