খানাখন্দে ভরে উঠেছে রাস্তা। কোনও কোনও জায়গায় সংস্কারের কাজও শুরু হয়েছে। কিন্তু সেই পিচ, পাথর টিকবে কত দিন? এই প্রশ্ন উঠেছে জেলায়।
মূলত অতিরিক্ত মালবাহীর ট্রাক-লরির দাপটেই রাস্তাগুলি ভাঙছে। পূর্ত দফতর থেকে প্রশাসনের কর্তা, শ্রমিক সংগঠন থেকে পরিবহণ মালিক- সকলেরই অভিযোগের আঙুল বালি ও পাথরবাহী ট্রাক-লরিগুলির দিকেই। কিন্তু পরিকাঠামোর অভাবে নজরদারির ক্ষেত্রে প্রশাসন কার্যত ‘নিধিরাম’- এমনটাই মনে করছেন নিত্যযাত্রীরা। ফলে বিপজ্জনক হয়ে পড়া এই সব রাস্তা দিয়ে কার্যত প্রাণ হাতে নিয়েই যাত্রীদের যাতায়াত করতে হচ্ছে। সংস্কার না হওয়ায় তাই ক্ষোভ ছড়াচ্ছে তাঁদের মধ্যে। |
সিউড়ি-সাঁইথিয়া ভায়া ইটাগড়িয়া, সিউড়ি-আমজোড়া, সিউড়ি-দুবরাজপুর, সাঁইথিয়া-বহরমপুর, সাঁইথিয়া-ষাটপলসা, বোলপুর-মল্লারপুর ভায়া সাঁইথিয়া, রামপুরহাটের ভাতিনা-নারায়ণপুর, রামপুরহাট-জয়পুর, নলহাটি-মোরগ্রাম, বোলপুর-ইলামবাজার, তেজহাটি-কুড়ুমগ্রাম রাস্তার অবস্থা খারাপ। একই অবস্থা মহম্মদবাজারের আঙ্গারগড়িয়া-দেউচা, কুলকুড়ি-মুরালপুর, দেউচা-কেন্দ্রসরাইল, হরিণসিঙা-পাঁচামি, চাতরা-জাজিগ্রাম, বুদিগ্রাম-তারাপীঠ ভায়া পারুলিয়া, রামপুহাট-আয়াস, অবিনাশপুর-সাহাপুর, খয়রাশোলের বড়া-জামতাড়া এই রাস্তাগুলি বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, রাস্তার অবস্থা এমনই যে যাতায়াত করা দুষ্কর হয়ে উঠেছে। বাসে যাতায়াত করতে সময় তো লাগেই, ঝাঁকুনিতে গা-হাত ব্যাথা করে। দুর্ঘটনাও ঘটছে।
পিডব্লউডি (রোডস)-এর এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র দেবাশিস ঘোষ, পিডব্লউডি হাইওয়ে ডিভিশনের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র জাহ্নবী কোনার, ন্যাশানাল হাইওয়ের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র বঙ্কিম সরকাররা রাস্তার বেহাল অবস্থার কথা স্বীকার করে নেন। তবে তাঁদের প্রত্যেকেরই দাবি, “অতিরিক্ত মালবাহী গাড়ি না চললে রাস্তাগুলির এই অবস্থা হত না। বিশেষ করে বালি ও পাথর বোঝাই ট্রাকগুলির জন্য এই অবস্থা।” তাঁরা জানিয়েছেন, এই ধরনের গাড়ির যাতায়াত রয়েছে সিউড়ি-সাঁইথিয়া, বোলপুর-ইলামবাজার ও সাঁইথিয়া-বহরমপুরের রাস্তায়। দেবাশিসবাবু বলেন, “ইতিমধ্যেই বোলপুর-ইলামবাজার, ইলামবাজারের খাগড়া-জয়দেব, মহম্মদবাজারের আঙ্গারগড়িয়া-দেউচা, সাঁইথিয়া-বহরমপুর, রামপুরহাটের ভাতিনা-নারায়ণপুর, রামপুরহাট-দুমকা, তেজহাটি-কুড়ুমগ্রাম প্রভৃতি রাস্তাগুলির অধিকাংশই পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের আর্থিক সহায়তায় সংস্কার করা হবে। টেন্ডারও করা হয়ে গিয়েছে।” তিনি জানান, ব্যাকওয়ার্ড রিজিওন গ্রান্ট ফান্ড-এর সহায়তায় সাঁইথিয়া-সিউড়ি রাস্তার কাজ শুরু হচ্ছে।
জাহ্নবীবাবু বলেন, “চাতরা-জাজিগ্রাম, সাঁইথিয়া-মল্লারপুর, শিবগ্রাম-ষাটপলসা, বুধিগ্রাম-তারাপীঠ, বড়া-জামতাড়া, অবিনাশপুর-সাহাপুর ইত্যাদি রাস্তাগুলির হয় কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে, নয়তো শীঘ্রই শুরু হবে।” বঙ্কিমবাবু জানান, মোরগ্রাম-রানিগঞ্জ জাতীয় সড়কের দুবরাজপুর থেকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তাটি সংস্কারের জন্য আনুমানিক ব্যায় ধরা হয়েছে প্রায় ৪৭ কোটি টাকা। তিনি বলেন, “রাস্তাটির বিভিন্ন অংশে মাঝেমধ্যেই সংস্কার করা হচ্ছে। তবে নলহাটি থেকে মোরগ্রাম পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। ওই অংশের সংস্কারের জন্য টেন্ডার ডাকার প্রক্রিয়া চলছে।” জেলা পরিষদের অধীনে থাকা কিছু রাস্তার অবস্থাও বেশ খারাপ। এ প্রসঙ্গে জেলা পরিষদের সভাধিপতি অন্নপূর্ণা মুখোপাধ্যায় জানান, জেলা পরিষদের অধীনস্থ রাস্তাগুলি প্রয়োজন মাফিক সংস্কার করা হচ্ছে। তাঁর অভিযোগ, “পাথর ও বালি ভর্তি ট্রাকগুলি অতিরিক্ত মাল বহন করছে। এ জন্যই মূলত রাস্তাগুলি খারাপ হচ্ছে।” |
তাঁর সঙ্গেই সহমত পোষণ করেছেন ডান-বাম শ্রমিক সংগঠনগুলির নেতৃত্বও। আইএনটিটিইউসি’র জেলা সভাপতি বিকাশ চৌধুরী, সিটুর জেলা সম্পাদক শেখ ইসলাম ও আইএনটিইউসি’র জেলা নেতা মৃণাল বসু বলেন, “অতিরিক্ত মালবাহী গাড়ির চলাচলেই রাস্তাগুলি ভাঙছে। সেই সঙ্গে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণেরও অভাব রয়েছে।”
প্রশ্ন উঠেছে, অতিরিক্ত মাল বহন ঠেকানো যাচ্ছে না কেন? জেলাশাসক জগদীশ প্রসাদ মিনা বলেন, “অতিরিক্ত মালবহন বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরকে নজরদাবি চালাতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে রাস্তাগুলি সংস্কারেও জোর দেওয়া হয়েছে।” বীরভূমের আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক রাজীব মণ্ডল দাবি করেছেন, “অতিরিক্ত মালবহন আটকানোর জন্য আমরা নিয়মিত নজরদারি চালাচ্ছি।” তবে একই সঙ্গে তাঁর স্বীকারোক্তি, “প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের দফতরে কর্মীর অভাব রয়েছে। তা ছাড়া বোলপুর ও রামপুরহাট মহকুমাতে আমাদের দফতরের কোনও পরিকাঠামো নেই। ফলে ইচ্ছা থাকলেও জেলার সর্বত্র নজরদারি চালানো যাচ্ছে না।” আর এই ফাঁকেই জেলার বিভিন্ন এলাকায় অতিরিক্ত মালবাহী গাড়ি রাস্তা দাপিয়ে যাচ্ছে বলে বাসিন্দাদের ক্ষোভ। যদিও সিউড়ি ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি তাপস সরকারের দাবি, “আমাদের সদস্যেরা কেউ ট্রাকে অতিরিক্ত মালবহন করেন না। নজরে এলে সতর্ক করে দেওয়া হয়। জেলাশাসকও এ ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে একই সঙ্গে আমরা চাইছি, প্রশাসন বিভিন্ন জায়গায় নজরদারি চালিয়ে অতিরিক্ত মালবহন হলে তা আটকানোর ব্যবস্থা করুক।” অন্য দিকে, লরি ও ট্রাক কর্মীদের সংগঠন সাঁইথিয়া লরি ইউনিয়নের সম্পাদক বিপত্তারণ সিংহের দাবি, “মালিকদের চাপেই আমাদের অতিরিক্ত মাল বহণ করতে হয়। ট্রাকের চালক ও খালাসিদের দোষ নেই।” বীরভূম জেলা বাস অ্যান্ড মিনিবাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক আবদুল আজিম বলেছেন, খারাপ রাস্তার জেরে গাড়ির যন্ত্রপাতি ভেঙে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে তাই পাড়ুই-বোলপুর ভায়া কসবা রুটে এক বছর ধরে বাস চালানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।” প্রশাসনের নজরদারির ফাঁকে ট্রাক-লরির অতিরিক্ত ভারে রাস্তা ভাঙছেই। রাস্তা সংস্কার হলেও অতিরিক্ত মালবহন বন্ধ না হলে অচিরেই ফের রাস্তা খানাখন্দে ভরে উঠবে। তাই ষাটপলসার বাসিন্দা নিত্যযাত্রী প্রশান্ত মণ্ডল কিংবা ইলামবাজারের নেপু সরকাররা ভোগান্তি কাটার আশু সম্ভাবনা দেখছেন না।
|