প্রবন্ধ ২...
বুলেটের শব্দে গণতান্ত্রিক স্বরটাই যদি চাপা পড়ে যায়
প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরও অজানা নয়। সার সার, চাদর চাপা দেওয়া লাশ, শুধু মুখগুলো বেরিয়ে আছে। সে সব মুখ আমাদের রোজের জীবনের ধারেকাছে দেখা যায় না, দেখার কথাও নয়! কিন্তু, মুখগুলোর একটা আলাদা পরিচয় আছে। প্রতিটি মুখের পৃথক পরিচয় নয়। সবারটা মিলিয়ে একটাই পরিচয় মাওবাদী। কখনও বা মাওবাদী-ঘনিষ্ঠ। অথবা, কট্টর মাওবাদী না হলেও মাওবাদীদের কোনও শাখা সংগঠনের সদস্য নিশ্চয়! না হলে কি আর গভীর রাতে মাওবাদীদের ডাকা সভায় হাজির হয় কেউ? নাগরিক সমাজ অবশ্য সে ভাবে জানে না যে, মাওবাদী প্রভাবিত এলাকায় বসবাস করলে তাদের ডাকা সভায় হাজিরা দেওয়াটা বাধ্যতামূলক! অতএব, আরও এক বার প্রয়োজন হয় রাতের অন্ধকারে ঘন জঙ্গলের আড়াল নিয়ে সশস্ত্র অভিযানের! প্রেক্ষাপট একই থাকে, শুধু বদলে যায় স্থান ও কাল। এ বারে যেমন ছত্তীসগঢ়ের বিজাপুর জেলার সকরেগুরার জঙ্গলে সশস্ত্র অভিযান।
অভিযানের পরের দিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, সঙ্গে সি আর পি এফের সগর্ব বিবৃতি, ছত্তীসগঢ়ের পুলিশকর্তাদের গলায় তৃপ্তির সুর প্রাণ বিপন্ন করে যৌথ বাহিনী কী ভাবে ‘সফল অভিযান’ চালিয়েছে, তার বিবরণ সব কিছুই বড় মসৃণ। কিন্তু, গোল বাধাল কতগুলি অস্বস্তিকর প্রশ্ন।
যে ১৯ জন যৌথ বাহিনীর গুলিতে মারা গেলেন, তাঁদের মধ্যে তিন জন মাওবাদীদের ‘গুরুত্বপূর্ণ নেতা’, অন্তত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম নয়াদিল্লিতে সে কথাই জানিয়েছিলেন। বাকিরা কারা? পরে চিদম্বরমই স্বীকার করলেন, ওই দিন বিজাপুরে সি আর পি এফের গুলিতে নিহতদের বেশির ভাগই নিরীহ মানুষ। সি আর পি এফ অবশ্য দমেনি। তারা দাবি করছে, নিহতদের সাত জন মাওবাদী, বাকিরা মাওবাদীদের শাখা সংগঠন গণ মিলিশিয়ার কি না তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কিন্তু, নিহতদের মধ্যে যে সাত জন কিশোরও রয়েছে? অন্তত, ছত্তীসগঢ় প্রদেশ কংগ্রেসের তথ্যানুসন্ধান কমিটি সে রকম রিপোর্টই তো পেশ করেছে! সেই কিশোরেরা কারা? মাওবাদীদের সমর্থক? গণ মিলিশিয়ার সদস্য? তা হলেও কি তাদের শরীর বুলেটে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়ার অধিকার জন্মে যায় রাষ্ট্রের? যে মহিলারা গুলিবিদ্ধ হলেন, এক জন মারাও গেলেন, তাঁরা সকলেই মাওবাদী নেত্রী?
ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ বলেছিলেন, মাওবাদীরা মানব-ঢাল ব্যবহার করেছে। নয়াদিল্লিতে সি আর পি এফের কর্তারাও আলোচনা করেছেন মানব-ঢাল নিয়ে। যেন মানব-ঢাল দুর্ভেদ্য, তা ভেদ করা যায় না! তা হলে আর সাধারণ পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আধা-সেনার তফাত কোথায়? দুঃখপ্রকাশ করেছেন চিদম্বরম। ‘যদি এ রকম ঘটনা ঘটে থাকে’ তা হলে তিনি দুঃখিত!
দুঃখিত তো এই গণতন্ত্রও! এই ‘মুক্ত’ গণতন্ত্রই যে জরুরি অবস্থার কালো দিনগুলোর কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে! ১৯৭৫-এর ২৬ জুন গোটা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন ইন্দিরা গাঁধী। ’৭৭ সালে জরুরি অবস্থা ওঠার পরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন গণতন্ত্রপ্রিয় যে সব মানুষ, তাঁরা তখন জানতেন না, রাষ্ট্রশক্তি মুখে যা-ই বলুক না কেন, গণতন্ত্রের আঙিনায় ভিন্নমতের ঠাঁই করে দেওয়ায় বড় আপত্তি তার। রাষ্ট্রপুঞ্জের দাবি-সনদেও মানবতা রক্ষার, মানবাধিকারের যে উল্লেখই থাক, এই অসহিষ্ণু পৃথিবীতে তার প্রয়োগ বড়ই দুষ্কর! এই দেশই তো বারে বারে সাক্ষী থেকেছে সেই চরম অসহিষ্ণুতার!
ছত্তীসগঢ়ে সাম্প্রতিকতম এই সংঘর্ষের পরেই সর্বভারতীয় স্তরে যে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে,তার মোদ্দা কথা, এই সংঘর্ষ ভুয়ো। মানবাধিকার ও সমাজকর্মী স্বামী অগ্নিবেশ, বি ডি শর্মা, জি হরগোপাল প্রমুখ বলেছেন, এটি ঠান্ডা মাথায় খুনের ঘটনা। অথচ, সি পি আই (মাওবাদী)-র পলিটব্যুরো সদস্য ও দলের মুখপাত্র আজাদের নিহত হওয়ার ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল, “আমাদের গণতন্ত্র তার নিজের সন্তানদের খুন করতে পারে না।”
দাঁতেওয়াড়ার সমাজকর্মী হিমাংশু কুমারের ‘বনবাসী চেতনা আশ্রম’ বুলডোজার দিয়ে আক্ষরিকই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সতেরো বছর ধরে ছত্তীসগঢ়ের প্রত্যন্ত দাঁতেওয়াড়ায় পড়ে থেকে গাঁধীবাদী হিমাংশু আদিবাসী মানুষকে তাঁদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে সচেতন করছিলেন। চিকিৎসক তথা মানবাধিকার কর্মী বিনায়ক সেনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দীর্ঘ কাল ধরে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে বর্তমানে বিনায়ক জামিনে মুক্ত থাকলেও সেই মামলা এখনও ঝুলছে। পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ-এর (পি ইউ সি এল) সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি বিনায়ক ও তাঁদের সংগঠন বহু বার ছত্তীসগঢ়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নানা ঘটনার তদন্ত রিপোর্টে সেখানকার বি জে পি সরকারকে প্রবল অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন।
ওই সংগঠনেরই উত্তরপ্রদেশ শাখার কার্যকরী সম্পাদক, সাংবাদিক সীমা আজাদের কথাই ধরা যাক। ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে ইলাহাবাদ স্টেশন থেকে সীমা ও তাঁর স্বামী বিশ্ব বিজয়কে গ্রেফতার করে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স। অভিযোগ ছিল, তাঁরা সি পি আই (মাওবাদী)-র সদস্য। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, ষড়যন্ত্র প্রভৃতি অভিযোগে ইউ এ পি এ-র একাধিক ধারা প্রয়োগ করা হয় তাঁদের বিরুদ্ধে। তাঁদের কাছ থেকে মাওবাদীদের বেশ কিছু কাগজপত্র উদ্ধার হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করে। ‘দস্তক’ বলে একটি মাসিক পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনস্তত্ত্বের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী সীমা। প্রায় আড়াই বছর মামলা চলার পরে ইলাহাবাদের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত এই দম্পতিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলির অভিযোগ, দিনের পর দিন রাজ্য সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা ঘটনা সামনে আনায় চরম অস্বস্তিতে পড়ছিল সরকার। তা ছাড়া, সীমার পত্রিকায় জমি-মাফিয়াদের বিরুদ্ধেও লাগাতার প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছিল।
এই তালিকা যথেষ্ট দীর্ঘ। যেমন, পস্কো আন্দোলনের নেতা অভয় সাহুর বিরুদ্ধে অন্তত ৫১টি মামলা। তিনিও বর্তমানে জামিনে মুক্ত। এ ছাড়া আদিবাসী সাংবাদিক লিঙ্গারাম কোরোপি, আদিবাসী শিক্ষিকা সোনি সোরি, মহারাষ্ট্রের মানবাধিকার কর্মী অরুণ ফেরেইরা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রতীক হয়ে লড়াই চালাচ্ছেন। মাওবাদী সন্দেহে ধৃত সোনি পুলিশি হেফাজতে তাঁর উপরে অকথ্য অত্যাচারের অভিযোগ এনেছেন।
এই গণতন্ত্রে আইন আছে, আছে বিচার বিভাগ। তারাই ঠিক করবে, ‘সমাজের মূল স্রোত’-এর বাইরে দাঁড়িয়ে যাঁরা ভিন্নমতের রাজনীতি করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের কী শাস্তি হবে। কিন্তু তার আগেই আইনরক্ষকদের বুলেট কারও প্রাণ ছিনিয়ে নিলে তার শাস্তি কে দেবে? ‘জল-জঙ্গল-জমিন’-এর অধিকারের জন্য যে প্রান্তবাসীরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের কয়েক জনের মৃত্যু বা হেফাজতে অত্যাচারিত হওয়ার কাহিনি মূল ধারার নাগরিক বিবেককে নাড়া দেবে, এমনটা নয়। তবে, গণতন্ত্রের ধ্বজা ওড়ানোর বড়াই যাঁরা করেন, তাঁরা কী করে ভুলে যান যে, এই গণতন্ত্রেই সসম্মানে নানা মতের ঠাঁই হওয়া উচিত? তার সঙ্গে আমরা সহমত হই বা না হই? বিতর্ক মাথাচাড়া দিক, গণতন্ত্রে তা স্বাস্থ্যকর। কিন্তু, বুলেটের আওয়াজ গণতন্ত্রের সেই সুরকেই তো চাপা দিয়ে দিল!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.