অশোকেন্দু সেনগুপ্তর লেখা উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বিজ্ঞান-শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধটি (১৫-৫) পড়ে এই পত্র। আমি দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে পাঠরত। অভিজ্ঞতা খুবই স্বল্প। তবু তার মধ্যেই যা কিছু দেখেছি, তার কিছু বিষয় আমি প্রকাশ করতে চাই।
প্রথমত, সিলেবাস। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের শিক্ষাব্রতীরা এক বারও কি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের সিলেবাসের পার্থক্যটা লক্ষ করেছেন? সাক্ষরতা বৃদ্ধি বা অন্য যে কারণেই হোক, মাধ্যমিকের সিলেবাস প্রতি বছর সহজ থেকে সহজতর হচ্ছে। এবং উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাস সম্ভবত সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলির জন্য নির্মিত সিলেবাসের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষার জন্য কঠিনতর হচ্ছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে পরীক্ষার্থীরা কার্যত খাল থেকে মহাসাগরে পতিত হচ্ছে।
|
আরও একটা কথা। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ হয়তো উচ্চমাধ্যমিক স্তরের জন্য আলাদা পাঠক্রম তৈরি করে থাকেন। কিন্তু শহরাঞ্চলে (হয়তো গ্রামাঞ্চলেও) বিজ্ঞান শিক্ষার যে বইগুলি ব্যবহৃত হয়, (রসায়ন, গণিত, পদার্থবিদ্যা ও জীববিদ্যার জন্য) সেগুলির পাঠক্রম কিন্তু শুধুই উচ্চমাধ্যমিকের পাঠক্রমের ভিত্তিতে গঠিত নয়। প্রায় প্রত্যেকটি বইয়ের উপরেই লেখা, ‘সকল উচ্চমাধ্যমিক, জয়েন্ট এন্ট্রান্স এবং আই আই টি জীববিদ্যার ক্ষেত্রে পি এম টি এবং এইমস পরীক্ষার্থীদের জন্য।’ এই সর্বভারতীয় পরীক্ষার উপযোগী করতেই বইগুলির কলেবর কাশীদাসী মহাভারত বা অভিধানগুলিকেও টেক্কা দিচ্ছে। যা পরীক্ষার্থীদের পক্ষে ভীতি উদ্রেককারী। বইতে প্রয়োজনের অনেক বেশি জিনিস লেখা থাকে। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মতো কোনও পৃষ্ঠাসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপার নেই।
দ্বিতীয়ত, গ্রামাঞ্চলের কথা জানি না। কিন্তু শহরাঞ্চলে বিজ্ঞান পড়ানো এক ধরনের ‘ব্যবসা’। আসলে অঘোষিত ভাবে বিজ্ঞান পড়ানোয় বিদ্যালয়ের থেকে গৃহশিক্ষক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই গণিত, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা বা রসায়ন পড়ানোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে এক-একটি ‘ব্যাচ’-এ ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৬০-৭০ ছুঁইছুঁই (বা তার বেশিও)। এ ভাবে প্রচুর ছাত্রছাত্রী নিয়ে প্রায় সভা ডেকে বিজ্ঞান শিক্ষা সার্থক ভাবে হওয়া সম্ভব? |
এ ছাড়া ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান-চেতনায় উৎসাহ বৃদ্ধি নিয়ে তো শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিশেষ ভাবিত বলে মনে হয় না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকাই প্রায় মুখস্ত বলার মতো করে দায়সারা ভাবে পড়িয়ে যান (সিলেবাস শেষ করার জন্য সময়ের অভাব একটা কারণ হতে পারে)।
তা ছাড়া উপযুক্ত পরীক্ষাগার, পরিকাঠামো, যথাযথ প্রয়োগের অভাব ইত্যাদি অনেক বিষয় আছে। অবশ্য এই রকম অবস্থা থেকেও প্রচুর ছাত্রছাত্রী দারুণ ফল করছেন। তাদের সাফল্য এবং মেধা কুর্নিশ করার মতো। সবশেষে আরও একটা কথা। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সিলেবাস প্রস্তুতকারকরা কিন্তু আই সি এস ই এবং আই এস সি-এর উচ্চমাধ্যমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের সিলেবাসের সমন্বয়টি দেখতে পারেন। ও রকম সমন্বয় থাকলে হয়তো পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার্থীরাও কিছুটা উপকৃত হবে এবং পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞান-চেতনা আরও বৃদ্ধি পাবে।
সৌরদীপ চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা-৫৫
|
বিজ্ঞানের প্রতি পড়ুয়াদের যে আগ্রহ, সেটা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার রাস্তা পাকা করার জন্য। বিজ্ঞান শেখবার জন্য নয়। কিন্তু কেন? বিষয় হিসেবে বিজ্ঞান কি তা হলে তার রহস্যময়তা হারিয়ে ফেলেছে? না কি প্রযুক্তির সাফল্যই বিজ্ঞানকে আড়াল করে ফেলছে?
আমাদের বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক বা আগ্রহ তৈরি হয় শৈশব থেকে। অনুশীলন করে তাকে ধরে রাখতে হয়। পরিবেশ, আত্মীয়-বন্ধু, স্কুল, অভ্যাস এ সব মিলে আমাদের মন তৈরি করে দেয়। বিশ্লেষণী ক্ষমতা জন্মায়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। অনেক ছাত্রছাত্রীকে দেখেছি, বিজ্ঞানের বৃহত্তর রহস্য সন্ধানে তেমন আগ্রহ না-থাকলেও, সে হয়তো অঙ্কে খুব ভাল। বা সে খুব জিজ্ঞাসু, সেই মেধা কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানে ঢুকে পড়েছে। সাধারণ মেধার ছাত্রছাত্রীদের বেলায় হয়তো বিজ্ঞানের কিছু প্রকরণের যথাযথ ব্যবহার না-শেখার ফলে প্রথম থেকেই একটা অনাগ্রহ পেয়ে বসে। আমার অঙ্কে মাথা নেই, কাজেই বিজ্ঞান আমার জন্য নয়, এই ধারণার বাইরেও যে বিজ্ঞানের বড় একটা আঙিনায় ‘রসের স্রোতে রঙের খেলা’ চলছে, এই বার্তা বোধহয় বহু পড়ুয়ার কাছে যথাসময়ে পৌঁছাচ্ছে না।
সমাজ যেমন ছাত্রকে, তেমনই শিক্ষককেও প্রভাবিত করছে। এই প্রসঙ্গে অশোকেন্দুবাবুর কটাক্ষ রূঢ়, তবে অর্থহীন নয়। যে মাস্টারমশাই পাঁচ রকম পাথরের আংটি পরেনতিনি পরুন, কিন্তু শিক্ষার্থীদের সেই পাথরের কেমিস্ট্রিটা শিখিয়ে দিন না। তার পর তারাই ঠিক করুক, কী করবে। কুসংস্কারের আড়ালে ‘বিজ্ঞান শিক্ষার উদ্দেশ্য’ ব্যর্থ হচ্ছে বলে অশোকেন্দুবাবু যে হতাশা ব্যক্ত করেছেন, মনে হয় এ ভাবে ভাবলে সে দ্বিধা কাটতে পারে। কবচ, তাবিজ, মাদুলি কোনও লক্ষ্যপূরণেই সাহায্য করতে পারে না। বিজ্ঞান পারে আর তাই বিজ্ঞানশিক্ষা প্রয়োজন। দ্বিধাহীন ভাবে সেটা আগে সমাজকে বিশ্বাস করতে হবে। বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানকক্ষের দরজা তখন আপনিই খুলে যাবে।
অরণ্যজিৎ সামন্ত। কলকাতা-৩৬ |