পাশাপাশি রাখতে পারি, কিন্তু কেন রাখব? ওরটা পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে
আমার
জায়গা করে নেব আমি। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের একটি ছবি দেখলেন স্বাতী ভট্টাচার্য |
বীরভূমের রামপুরহাটে একটি গ্রাম। প্রাইমারি স্কুলে গ্রাম সংসদের বার্ষিক সভা বসেছে। সংসদ এলাকার সব ভোটারদের সামনে আয়-ব্যয়ের হিসেব দেবেন পঞ্চায়েত কর্তারা, গ্রামে কে কী সরকারি সুবিধে পাচ্ছে তার তালিকা শোনাবেন। জুন মাসের মানুষ-মারা গরমেও ভিড় জমে উঠছে। গ্রামের মেয়ে-পুরুষ কেউ একা, কেউ ছোট ছোট দঙ্গলে এসে ঢুকছেন লম্বা একটা ক্লাস ঘরে।
প্রায় প্রত্যেকেই চটিজোড়া খুলছেন ঠিক দোরগোড়ায়। তার পর চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঢুকে পড়ছেন ঘরে। পরের জন এসে পাশের দিকে পা চালিয়ে আগের জনের চপ্পল সটান সরিয়ে দিয়ে নিজের চটিজোড়া সেই জায়গাটিতে রেখে ঢুকে যাচ্ছেন। রোদ ঝুঁকে এল, শুরু হল গ্রাম সংসদের বৈঠক। ততক্ষণে উঠোন জুড়ে প্রায় দেড়শো জোড়া চটি এলোমেলো, ছত্রখান।
এ যেন আমাদের গণতন্ত্রেরও চেহারা। চটিগুলো সারি দিয়ে রাখা এমন কিছু কঠিন নয়। তবু কেন তা রাখা যায় না, তা আন্দাজ করা গেলে এ-ও বোঝা যাবে যে, কেন রাস্তা তৈরির টাকা ফিরে যায় অথচ হাঁটতে হয় হাঁটু-কাদায়, বিদ্যুতের খুঁটি পুঁতে যাওয়ার পরেও আলো আসে না অর্ধেক গ্রামে, কেন মালপাড়া কি মোল্লাপাড়ায় বন্যায় ধ্বসে-পড়া বাড়ি উঠে দাঁড়ায় না আবার।
গরিব মানুষ যে জীবনে নিতান্ত দরকারি জিনিসগুলো পান না, আর তার জন্য অত্যন্ত কষ্ট ভোগ করেন, তা একশোবার ঠিক। কিন্তু এও ঠিক যে সে অবস্থাটা বদলানোর যত সুযোগ গত দশ-বিশ বছরে গ্রামের মানুষের হাতে এসেছে, তা এ দেশের ইতিহাসে কখনও আসেনি। এমনকী বিশ্বের ইতিহাসেও গ্রামের মানুষের হাতে সরাসরি এত টাকা, এত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কি না, তা গবেষণার বিষয়। আজ এক একটা গ্রাম পঞ্চায়েত বছরে আড়াই-তিন কোটি টাকা খরচ করে হেসে-খেলে, আরও টাকা খরচ করতে পারলে আরও বরাদ্দ পাওয়ার দরজা খোলা তাদের। জেলা-ব্লক-পঞ্চায়েত, এই তিন স্তরের পঞ্চায়েত একত্রে চেষ্টা করতে পারলে গ্রামে রাস্তা থেকে বিদ্যুৎ, জল থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কোনটা বাকি থাকত এ রাজ্যের গ্রামে? একশো দিনের কাজে এ রাজ্য সর্বোচ্চ আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে, ৩১ দিন কাজ দিয়ে। একশো দিনের কাছাকাছি কাজ দিতে পারলে তার তিন গুণ টাকা পাওয়া যেত। এ বছর রাস্তা তৈরি করতে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা দেবে কেন্দ্র। পানীয় জলের জন্য চার হাজার কোটি টাকারও বেশি। |
দশে মিলে? নিকাশি নালার সংস্কারে গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যরা। মাতলা, ক্যানিং |
তা সত্ত্বেও গ্রামের উন্নতি হচ্ছে না, এ দায় কার? পঞ্চায়েতের প্রধান চোর, সচিব ঘুষখোর, ব্লক সভাপতি বিরোধী বলে কাজ করেন না, এ কথাগুলো কিছু দূর গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। বাড়ি থেকে দামি জিনিস নিত্য খোওয়া যাচ্ছে, আর বাড়ির মালিক কখনও দারোয়ানকে, কখনও খাজাঞ্চিকে গাল পেড়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকছেন—এমন যদি চলতে থাকে প্রতিদিন, তা হলে চেঁচামেচিটাও কেমন নাটুকে মনে হতে থাকে। কেন এত এলোমেলো দশা, কেন নজর রাখো না আগে থাকতেই?
নজর রাখতে গেলে জানতে হয়, কোনটা কোথায় থাকার কথা। অমুকের চটির বাঁ দিকে থাকবে আমার চটি, আর ডান দিক থেকে এতগুলো চটি ডিঙিয়ে আসতে হবে আমার চটি জোড়ায়, এমনটা জানা থাকলে ধরা যায় চটি খোওয়া গেল কি না। কোন কাজটা কখন হবে, কোথায় হবে, কত টাকায় হবে, তার গোটা নকশাটা স্পষ্ট থাকলে নিজে কী পাব, কবে পাব, তা-ও বুঝে নেওয়া চলে। নিজের জায়গা করতে গিয়ে অন্যকে সরিয়ে দিতে হয় না।
আর নকশাটা জানার সব চেয়ে সহজ উপায়, নকশাটা নিজেই তৈরি করা।
সেই কাজের শুরু হয়েছিল এ রাজ্যেই। আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত মেদিনীপুরে ‘গ্রামবাসীদের দ্বারা গ্রাম পরিকল্পনা’ তৈরি করার কাজ হয়েছিল। নারায়ণগড় ব্লকে গ্রামের লোকেরা বসে তৈরি করেছিল নিজেদের গ্রামের উন্নয়নের পরিকল্পনা। কথা হয়েছিল, প্রতি পঞ্চায়েত হাতে পাবে এক লক্ষ টাকা, নিজের পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য। সে টাকা আর আসেনি --বামপন্থী নেতা আর সরকারি আমলাদের বাদ সাধায় ভেস্তে গিয়েছিল। সম্প্রতি গ্রামের মানুষকে নিয়ে নকশা তৈরি করার আর একটা উদ্যোগ এসেছিল। ব্রিটিশ সরকারের অনুদানে গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণকে আরও সবল করতে প্রায় ৩০০ কোটি টাকায় চলেছিল পাঁচ বছরের একটি প্রকল্প। প্রায় এক হাজার গ্রাম পঞ্চায়েতে গ্রামের মানুষকেই পরিকল্পনা করা, হিসেব রাখার কাজ শেখানো হয়েছিল যত্ন করে।
যে সব গ্রামে মানুষ উৎসাহী হয়ে কাজে নেমে পড়েছিলেন, দেখা গিয়েছিল সে সব জায়গায় দলাদলিকে ডিঙিয়ে টাকা খরচ হয়েছে গ্রামের কাজে। উপরমহলে নেতারা যখন এ ওকে বয়কট করছেন, তখনও গ্রামে সব দলের লোক বসে একসঙ্গে পরিকল্পনা করছেন, টাকা কেমন করে খরচ হবে। কথাবার্তায় প্রধানরা অনেকে স্বীকার করেছেন, বিরোধী সংসদে টাকা খরচ হচ্ছে ভাল, তাই তাদের বরাদ্দও করা হচ্ছে বেশি। সেই সময় এক পঞ্চায়েত সদস্যকে প্রশ্ন করা গিয়েছিল, ‘তবে কি উন্নয়ন অরাজনৈতিক?’ তিনি বলেছিলেন, ‘না, রাজনীতির বাইরে নয়, তবে রাজনীতির ঊর্ধ্বে।’ নিজেদের মতো করে অন্তত কিছু গ্রামে মানুষ দলাদলি থেকে সরে এসে একটা জমি তৈরি করছিলেন, যেখানে দাঁড়িয়ে গ্রামের মানুষ গ্রামের টাকা গ্রামের কাজে খরচ করবে।
ব্রিটিশ প্রকল্পের টাকা শেষ হল, সেই চেষ্টারও ইতি হল। গ্রাম উন্নয়ন কমিটির সদস্যরা যা শিখেছিলেন, ভুলে গেলেন। এত টাকা, এত সময়, মানবসম্পদে এত বিনিয়োগ, সবই জলে গেল।
এতে আফশোস যতই হোক, আশ্চর্য হওয়ার উপায় নেই। রাজনীতির নেতারা গ্রামবাসীর হাতে পরিকল্পনার ক্ষমতা, টাকা বরাদ্দ, খরচ, হিসেব দাখিলের ক্ষমতা ছাড়তে চাইবেন না, সে তো স্বাভাবিক। কিন্তু গ্রামবাসীরও যে নিজেরা পরিকল্পনা করার খুব চাড় রয়েছে, তা বলা চলে না। ‘প্ল্যানিং’ মানে অনেক খুঁটিনাটি কাজ, অনেক কথাবার্তা, অনেক ঝক্কি। তার চাইতে গরিব মানুষ বরাবরই আস্থা রেখেছেন রাজনৈতিক দলে। আন্দোলন করে টাকার উৎসে, ক্ষমতার উৎসে চাপ দিয়ে নিয়ে আসতে হবে নিজের পাওনা। দল যদি কথা না শোনে, দল বদলে দিতে হবে।
মুশকিল হল, গরিবের কথায় কান না দিলেও নেতাদের চলে যায় দিব্যি। গ্রামের জন্য কিচ্ছুটি না করে বছর বছর ভোটে জিতে আসা যায়। রামপুরহাটের যে সংসদে সে দিন মিটিং চলছিল, তার সদস্য এই নিয়ে চার বার জিতে এসেছেন। এখনও তাঁতিপাড়ার দিকে রাস্তা কাঁচা, সে দিন সভাশেষে ঝড়বৃষ্টিতে গ্রামের পথ কাদার তাল হয়ে গেল। সন্ধ্যা নামতেই পিচ-কালো অন্ধকারে ডুবে গেল গোটা এলাকা। গ্রামে কেউ ‘সমবায়’ কী জিনিস জানেন না। বিরোধী নেতারা শাসক দলের কারচুপি ধরিয়ে দেবেন, সে গুড়েও বালি। তাঁরা হাত মেলান, নইলে থাকেন তক্কে তক্কে। গ্রামের মানুষ কপাল চাপড়ে বলেন, সব দলই এক। ‘পরিবর্তন’ আসার পর সেই দীর্ঘশ্বাস আরও গভীর হচ্ছে।
ফলে ‘সকলের উন্নয়ন হলে আমারও হবে,’ সে আশা ছেড়ে দিয়ে হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তরা সকলের বরাদ্দ থেকে নিজের জন্য দু-চার আনা আদায় করার জন্য চক্কর কাটেন। আয়লার এলাকায় দেখা গিয়েছে, যার ঘর বাঁধের পাশেই, সে-ও বাঁধ থেকে বাঁশ চুরি করে নিয়ে আসছে ঘরে। ও বাঁধ তো হবে না, সবাই চুরি করবে। বাঁধ ভাঙবেই, আমার ঘরও আবার ভাসবে, তা হলে এই বেলা দুটো বাঁশ ছাড়ি কেন? ও পাচ্ছে, আমি বাদ যাই কেন? ওর চটিটা কেন সরিয়ে দেব না আমার পায়ের ধাক্কায়?
আজ গ্রামের মানুষের এ কূল ও কূল, দুই-ই গিয়েছে। দলাদলির বাইরে একটা কাজ-চালানো সহযোগিতার জমি তৈরি করে উন্নয়নের টাকা খরচ করবে, সে আর তার হল না। আবার নেতাদের চাপে রেখে নিজের হক বুঝে নেওয়ার উপায়ও তার নেই। গ্রামবাসী নিজেরা উন্নয়নের নকশা তৈরি করেননি, যাঁরা করেছে তাঁরাও তাঁদের কিছুই জানাবেন না। ফলে কোথায় কী হচ্ছে কোনও তথ্যই থাকে না গ্রামের মানুষের কাছে। আজ সংসদ বৈঠকে যখন এক বৃদ্ধা বলেন, ‘আমি দু’বছর বিধবা ভাতা পাইনি’ তখন পঞ্চায়েত প্রধান ধমকে দেন, ‘এই ব্লকের কেউ ভাতা পায়নি।’ যখন কোনও সংসদে গ্রামের পুরুষ-মহিলা ফেটে পড়েন একশো দিনের কাজে ১৩৬ টাকা রোজের বদলে ৮০-৯০ টাকা পাচ্ছেন, তাঁদের বলা হয়, ‘তোমরাই তো এই পঞ্চায়েতে সব চেয়ে বেশি পাচ্ছ।’ আদতে কে কী পাচ্ছে, না পেলে কেন পাচ্ছে না, কিছুই না জানার ফলে গ্রামের মানুষ প্রাপ্য আদায় করতে পারছেন না। বরং তাঁদের মধ্যে এক ধরনের অবোধ, অযৌক্তিক আতঙ্ক কাজ করে চলেছে যে, ও পেয়ে গেলে আমার আর পাওয়া হবে না, ওর হলে আমার হবে না। আমায় ঢুকে পড়তে হলে ওকে সরিয়ে দিয়েই ঢুকতে হবে।
এই খেয়োখেয়িতে নেতাদের পোয়াবারো। সংসদ বৈঠকে যে যার নিজেরটা আদায় করার জন্য গুঁতোগুঁতি শুরু হলে আয়-ব্যয়ের হিসেব, অডিট রিপোর্ট পেশ করা এলেবেলে হয়ে যায়। যাঁদের পরীক্ষা দেওয়ার কথা গ্রামবাসীর কাছে, গ্রামবাসীরাই তাঁদের কাছে প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে যান। পঞ্চায়েত কর্তারা সহজেই নিরাপদ দূরত্ব তৈরি করে নেন। সে দিন স্কুলের উঠোনে দেড়শো চটির মধ্যে পঞ্চায়েত কর্তাদের জুতো ছিল না। জনতার সতরঞ্চিতে নয়, গোটা কতক প্লাস্টিকের চেয়ারে প্রধান, মেম্বার, সচিবরা বসেছিলেন। জুতো পরেই। |