কৌটিল্য অতিশয় বুদ্ধিমান ব্যক্তি, স্পষ্ট বলিয়া গিয়াছিলেন, মনের কথা সাফ সাফ কহিয়া দিবার কোনও অর্থ নাই, ঘুরাইয়া বলো; কারণ, অতি সততা মূল্যহীন, অরণ্যে ঋজু বৃক্ষেরাই সর্বাগ্রে কর্তিত হইয়া থাকে। প্রচলিত তথা ফলিত রাজনীতি তাঁহার সেই মোক্ষম শলাটি শিরোধার্য করিয়াছে। রাজনীতি-সমন্বিত অর্থনীতিও যে তাহা মানে না এমন নহে। সুতরাং, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু মহাশয় ঈষৎ ঘুরাইয়া বলিলেন, রাজনীতিকরা অনেকেই বুদ্ধিমান, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ব্যতিক্রম নহেন, তিনি নিশ্চয় বুঝিবেন খুচরা ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আসিলে কী বিপুল লাভ! কৌশিক বসুর অজানা নহে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিশেষ উদ্যোগের ঘোরতর বিরোধী। তিনি যে দলের সর্বময়ী নেত্রী, সেই তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনী ইস্তাহারে খুচরা ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ রুখিবার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছে। অতঃপর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়াটি কার্যত প্রত্যাশিতই ছিল। মমতা সেই প্রত্যাশা অপূর্ণ রাখেন নাই। বিবৃতি দিয়া তিনি এই প্রস্তাব খারিজ করিয়া দিয়াছেন। যাহা ঘটিবার ছিল তাহাই ঘটিয়াছে। কিন্তু তাহার পরেও কৌশিকবাবুর মন্তব্যটি থাকিয়া গিয়াছে। থাকিয়া গিয়াছে তাহার অন্তরে নিহিত একটি গূঢ় প্রশ্ন। ‘বুদ্ধি’ কাহাকে বলে? ‘বুদ্ধৌ শরণম্ অণ্বিচ্ছ’। অর্থাৎ, বুদ্ধির শরণ নাও। গীতায় শুনিয়াছিলেন মহাবীর অর্জুন। কী সেই বুদ্ধি? প্রশ্নটি আসলে গভীরতর। বুদ্ধি আর প্রজ্ঞা কি সমার্থক? প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক কি বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদের সহিত সমার্থক? না কি, রাজনৈতিক বুদ্ধি ক্ষেত্রবিশেষে প্রজ্ঞার পথ রোধ করিয়া দাঁড়ায়? ‘প্রজ্ঞা’র পথ যদি ‘বুদ্ধি’-র বিপরীতে চলে, তখন? রাজনীতিবিদ বলিবেন, সুপক্ব রাজনীতিবিদের ক্রিয়াকাণ্ডে ‘বার্তা’ প্রেরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে এই কাজটি অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন লইয়া রাজনৈতিক পরিসর সরগরম। সেই অবস্থায় বিভিন্ন শিবির হইতে বিভিন্ন তরফে ‘বার্তা’ যাইতেছে। সরাসরি বৈঠক যদি না-ও হয়, যদি কাহাকেও সমর্থন দিবার বা না-দিবার কথা বাতাসে ভাসিতে থাকে, তখন ‘বার্তা’ চলিতে পারে। অর্থাৎ, কথাটি রহিল বটে প্রকাশ্যে, কিন্তু অর্ধস্ফুট রহিল। তাহাকে পূর্ণ করিয়া লইবেন তিনি, যাঁহার উদ্দেশে সেই বার্তা প্রেরণ। তিনি তাঁহার মতো করিয়া করিবেন। সেই ব্যাখ্যা মূল বার্তাপ্রেরকের অভিপ্রায়ের সহিত মিলিতে পারে। না-ও পারে। ইহাই রাজনীতির দস্তুর।
পুনরায় প্রশ্ন উঠিবে, বার্তা, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? প্রজ্ঞা, না বুদ্ধি? ‘বার্তা’ ঈষৎ ধূসর। সম্পূর্ণ সাদা নহে, নিকষ কালোও নহে। প্রেরক এবং প্রাপকের ভিতর একটি বিচিত্র উভমুখী অঞ্চলে তাহার বাস। ব্যক্তিসাপেক্ষে তাহার চরিত্র বদলায়। একই বার্তা কোথাও শুভ্র, কোথাও কৃষ্ণ বলিয়া প্রতিভাত। কারণ, রাজনীতিতে চূড়ান্ত বলিয়া কিছু নাই। এমনও হইতে পারে, আজ যিনি একটি বার্তাকে অতীব সদর্থক বলিয়া ভাবিলেন, পরবর্তী দিনই সেই বার্তা তাঁহার নিকট নঞর্থক রূপে দেখা দিল। অতএব রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে ‘সত্য’ অতীব আপেক্ষিক। সত্যটি স্বার্থসাপেক্ষও বটে। রাজনীতিবিদগণ জানেন, সবার উপরে স্বার্থ সত্য, তাহার উপরে নাই। সুতরাং, যে কোনও কথারই কোনও একটিমাত্র অর্থে স্থিত থাকা অর্থহীন। কখনও কখনও প্রজ্ঞা এই তীব্র চলমানতার, এই স্বেচ্ছাবৃত দোদুল্যমানতার বিরোধিতা করিতে পারে। মনে হইতে পারে, বৃহত্তর স্বার্থ বা যুক্তি বলিতেছে যে ক্ষুদ্রতর স্বার্থ বা যুক্তির দোহাই দিয়া অমুক কাজটি করা বা না-করা উচিত নহে। তখন বুদ্ধি কী করিবে? ইহাই প্রশ্ন। ‘বার্তা’ দিবে কি? উত্তর মিলে না। ‘বার্তা’ চলিতে থাকে। |