মিশরের প্রথম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুর্সি শপথ গ্রহণ করিয়াছেন, এক সপ্তাহও কাটে নাই। তাহারই মধ্যে সে দেশে সমূহ সাংবিধানিক সঙ্কট ঘনাইয়া উঠিল। সঙ্কটের মূলে প্রেসিডেন্টের একটি নির্দেশ। তিনি সামরিক পরিষদের ভাঙিয়া দেওয়া নির্বাচিত পার্লামেন্টকে জিয়াইয়া তোলার নির্দেশ দিয়াছিলেন। সামরিক পরিষদ আবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দেশের প্রথম নির্বাচিত প্রতিনিধিসভাকে ‘অবৈধ’ গণ্য করিয়া ভাঙিয়া দেয়। এ সব ঘটনা প্রেসিডেন্ট মুর্সির নির্বাচিত হওয়ার অব্যবহিত পূর্বেই পরিকল্পিত ভাবে ঘটানো হয়। শীর্ষ আদালত ও সামরিক পরিষদ মিলিত ভাবে মিশরে গণতন্ত্রের আবাহনের পথে অবরোধ সৃষ্টি করিতেই তৎপর হইয়াছিল। দেশে কোনও সংবিধান না-থাকায় ইচ্ছা মতো নির্দেশ জারি করিয়া কিংবা রায় দিয়া এই দুই অনির্বাচিত সংস্থাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বের বৈধতা কাড়িয়া লওয়ার চেষ্টা করিতেছিল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হইয়াই মহম্মদ মুর্সি সংস্থা দুইটির কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাইলেন।
হোসনি মুবারক এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের ঐতিহ্য মিশরকে এত সহজে ছাড়িয়া যাইবে না। মুবারক ক্ষমতাচ্যুত হইলেও তাঁহার জমানার এবং তাঁহারই নিযুক্ত বিচারপতিগণ ও সামরিক আমলাতন্ত্র এখনও বহাল। এই দুই গোষ্ঠীই নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি করিয়া নির্বাচিত সংস্থার হাতে শাসনভার অর্পণ করার পথে রকমারি বাধা সৃষ্টি করিতেছে। নির্বাচিত পার্লামেন্টকে অবৈধ ঘোষণা করিয়া ভাঙিয়া দেওয়া ছিল মিশরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তেমনই একটি অন্তর্ঘাত। এই অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার অধিকার আদালত বা সামরিক পরিষদের থাকিতে পারে না। সামরিক পরিষদ একই সঙ্গে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা খর্ব করিয়া যে-সব নির্দেশনামা জারি করে, তাহাও একতরফা, স্বৈরতান্ত্রিক এবং অভিসন্ধিমূলক। সমগ্র দেশবাসী যাঁহাকে তাঁহাদের শাসনকর্তা বলিয়া বাছিয়া লইতেছেন, তাঁহার ক্ষমতা ও এক্তিয়ারের সীমা বাঁধিয়া দেওয়ার অধিকার কোনও অনির্বাচিত জেনারেলের থাকিতে পারে না। এই জেনারেলরা, বিশেষত তাঁহাদের নেতা তান্তাভি যে আর এক জন হোসনি মুবারক হইয়া উঠিতে চাহেন, তাহার লক্ষণ ক্রমেই স্পষ্ট।
মুবারকের এক কালের বিশ্বস্ত এই সব জেনারেল ও বিচারপতিরা এখনও দেওয়ালের লিখন পড়িতে পারিতেছেন না। ‘আরব বসন্ত’ পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম জনসমাজে গণতন্ত্রের জন্য যে তীব্র আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়াছে, তাহার অঙ্গ হিসাবেই টিউনিসিয়ায়, মরক্কোয়, লিবিয়ায়, মিশরে রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটিতেছে। এই জমানা-বদল ইতিহাসের অমোঘ গতি, যাহাকে প্রাণপণে পিছনে টানিয়া রাখার চেষ্টাও ব্যর্থ হইতে বাধ্য। মিশরের জেনারেলরা কিছু কাল দমন নীতি চালাইয়া, কার্ফু জারি করিয়া, যথেচ্ছ প্রতিবাদী জনসাধারণের উপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ করিয়া নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন পরিচালনার অধিকার খর্ব করিতে পারেন। বরাবর এ ভাবে চলিবে না। কেননা ওই জেনারেলদের বা বিচারপতিদের পিছনে কোনও জনসমর্থন নাই, তাঁহারা স্বৈরতান্ত্রিক স্থিতাবস্থা রক্ষার প্রহরী মাত্র। ইতিহাসে তাঁহাদের প্রয়োজন ফুরাইয়া গিয়াছে। গণতান্ত্রিক পালাবদল রাজনৈতিক ইসলামের উত্থানের সুযোগ করিয়া দিতেছে, এই অপযুক্তি পাড়িয়া প্রতিনিধিত্বের বৈধতাবর্জিত স্বেচ্ছাচার কায়েম রাখাও আর চলিবে না। একবিংশ শতকের মিশর বিংশ শতাব্দীর আলজিরিয়া নয়। |