|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
অস্ত্রের ঝঙ্কারই কি শেষ কথা? |
তাপস সিংহ |
ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন জঙ্গলমহল/ পিপল, স্টেট অ্যান্ড মাওয়িস্টস, সম্পাদনা: বিশ্বজিৎ রায়। সেতু প্রকাশনী, ৫০০.০০ |
ছত্তীসগঢ়ের বিজাপুরে সম্প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মাওবাদীদের গুলি বিনিময়ের সময় ১৯ জনের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে সেই অমোঘ প্রশ্ন আরও এক বার সামনে চলে এল। শান্তি কোন পথে? কী ভাবে এগোলে ‘দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় শত্রু’দের শান্তির পথে ফেরানো যাবে? কোন পথে চললে রাষ্ট্রশক্তির নির্বোধ আস্ফালন আরও একটু সংযত হবে?
শান্তি প্রক্রিয়ার চেষ্টাটা এ দেশে অবশ্য সুসংহত নয়। বিশ্বের নানা প্রান্তে ভিন্ন মতের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে, চিরচেনা পথের বাইরের ভিন্ন ধারার শক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের বহু আগে থেকে শান্তি আলোচনার পর্ব চললেও আমাদের দেশে এই প্রক্রিয়া নতুন। নানা রাজ্যে নানা সময়ে সেই প্রক্রিয়া শুরু হলেও অচিরেই তা নিষ্ফল বাগাড়ম্বরে পরিণত হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে অবিশ্বাসের বাতাবরণেরও। বারে বারে প্রশ্ন উঠেছে, এই বাতাবরণের মধ্যে কী করে কোনও শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হতে পারে? ‘সমাজের মূলস্রোত’-এর বাইরে গিয়ে যদি কোনও রাজনৈতিক দল প্রান্তিক মানুষের অভাব-অভিযোগ নিয়ে কথা বলে, তাদের দমন করার জন্য অস্ত্রের ঝঙ্কারই কি শেষ কথা?
রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে মূলত আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে রাজনীতি করা মাওবাদীদের শান্তি আলোচনার পরিণতি সেই ২০০৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ করেছিল গোটা দেশ। এর পরে ২০১১-য় ওড়িশায় এক জেলাশাসক এবং এক ইঞ্জিনিয়ারকে অপহরণ ও তার জেরে মধ্যস্থতার গুরুত্ব উপলব্ধি করে মাওবাদী ও সরকার, দু’পক্ষই। আর, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ‘পরিবর্তন’-এর বছরেই শুরু হয়েছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সেই শান্তিপ্রয়াস। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরানোর সেই উদ্যোগ গতি পেয়েছিল রাজ্য সরকারের তরফে মধ্যস্থতাকারীদের নিয়োগের মাধ্যমে। ওই মধ্যস্থতাকারীদের মেনে নিয়েছিলেন মাওবাদীরাও। সরকার ও মাওবাদীদের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীদের কয়েক দফা আলোচনার পরেও সেই প্রয়াস ভেস্তে যায়। ইস্তফা দেন মধ্যস্থতাকারীরা।
পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল এবং তার সঙ্গেই গোটা দেশে মাওবাদী আন্দোলন, হিংসা-পাল্টা হিংসা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে শান্তি আলোচনার ব্যর্থতা— সব মিলিয়ে এক পূর্ণাঙ্গ ছবি তুলে ধরেছে ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন জঙ্গলমহল/ পিপল, স্টেট অ্যান্ড মাওয়িস্টস গ্রন্থটি। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে মাওবাদী আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতা, জঙ্গলমহলের কৃষক আন্দোলনের নানা দিক এবং বিবদমান দুই পক্ষকে কোন পথে, কী ভাবে আলোচনার টেবিলে আনা যায়, সে সব নানা দিক আলোচিত হয়েছে এই সংকলন গ্রন্থে।
প্রবন্ধগুলিকে মূলত চারটি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে এই রাজ্যের জঙ্গলমহলে শান্তি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হল কেন, কোন পক্ষই বা দায়ী, তা নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, অসীম চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষ রানা, মহাশ্বেতা দেবী, রণবীর সমাদ্দার, পার্থসারথি প্রমুখ। এই অধ্যায়ের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এখানে সরকার নিযুক্ত ছ’জন মধ্যস্থতাকারীর মধ্যে চারজন সুজাত ভদ্র, ছোটন দাস, অশোকেন্দু সেনগুপ্ত ও দেবাশিস ভট্টাচার্যের নিবন্ধ আছে। দেবাশিসের পর্যবেক্ষণ ও দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য বাকি তিনজনের থেকে আলাদা।
মাওবাদীদের সঙ্গে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে মধ্যস্থতাকারীরা তাঁদের সীমারেখা লঙ্ঘন করেছেন কি না, সেই বিতর্কের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সুজাত। বলেছেন, সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার অধিকার অবশ্যই মধ্যস্থতাকারীদের আছে। তাঁরা নিছক বার্তাবাহক নন। দু’পক্ষের মতপার্থক্য ও বিরোধের জায়গাগুলি চিহ্নিত করে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপ্রক্রিয়ার রূপরেখা তৈরি করার চেষ্টা করবেন মধ্যস্থরা। রণবীর সমাদ্দার সঠিক ভাবেই বলেছেন, টানা তিন বছরের লড়াই এবং মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেণজির মৃত্যুর পরে নিশ্চিত ভাবেই জঙ্গলমহল তথা গোটা দেশে শান্তিপ্রক্রিয়ার উপরে যবনিকা পতন হয়েছে। অন্তত অদূর ভবিষ্যতে এই প্রক্রিয়া কার্যকরী হবে না।
অনিবার্য কারণেই জামবনির বুড়িশোলের জঙ্গলে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে কিষেণজির মৃত্যুর প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে বিভিন্ন নিবন্ধে। আলোচিত হয়েছে, কিষেণজির মৃত্যুর পরে, বিশেষ করে এই রাজ্যে মাওবাদী আন্দোলনে বিশাল শূন্যতার কথা।
গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় এবং অন্যত্র শান্তিপ্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতার নিরিখে কলম ধরেছেন বিনায়ক সেন, ভারাভারা রাও, জি হরগোপাল, স্বামী অগ্নিবেশ, হিমাংশু কুমার, নন্দিনী সুন্দর, মনোরঞ্জন মোহান্তি প্রমুখ। এই অধ্যায়েই রয়েছে ২০০৫-এর ২৬ জানুয়ারি ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’-তে প্রকাশিত অন্ধ্রের মানবাধিকার কর্মী প্রয়াত কে বালাগোপালের একটি বহু আলোচিত নিবন্ধ। ২০০৪-এ অন্ধ্রপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই এস রাজশেখর রেড্ডির উদ্যোগে মাওবাদীদের সঙ্গে সরকারের শান্তি আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ওই নিবন্ধ লিখেছিলেন বালাগোপাল। লিখেছিলেন, রাজ্য সরকার বলছে, তারা এখনও আলোচনায় রাজি, কিন্তু নকশালপন্থীরাই আলোচনা ভেস্তে দিয়েছেন। কিন্তু সরকার যেটা বলছে না তা হল, তাঁদের ক্যাডারদের হত্যা বন্ধে সরকারের কোনও আগ্রহ নেই বুঝতে পেরেই নকশালপন্থীরা আলোচনা ভেঙে দেন।
অন্ধ্রই প্রথম নকশালপন্থীদের সঙ্গে সরকারের শান্তিপ্রক্রিয়ার পথ দেখায় গোটা দেশকে। জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর উপর থেকে সাময়িক ভাবে ‘নিষিদ্ধ’ তকমা তুলে নেওয়া হয়। এমনকী, প্রকাশ্যে বিশাল রাজনৈতিক সভা করেন নকশালপন্থীরা। কিন্তু তার পর থেকেই পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নিতে থাকে। সেই পর্ব বহু আলোচিত।
বিভিন্ন নিবন্ধে প্রাসঙ্গিক ভাবে উল্লিখিত হয়েছে সিপিআই-এর (মাওবাদী) আর এক পলিটব্যুরো সদস্য আজাদের মৃত্যুর প্রসঙ্গও। ক্ষমতায় আসার আগে ও পরে মাওবাদীদের প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কথা বলেছেন স্বামী অগ্নিবেশ। ২০১০-এর ৯ অগস্ট লালগড়ের জনসভায় অগ্নিবেশ বলেছিলেন, ভুয়ো সংঘর্ষে আজাদের মৃত্যু হয়েছে। এই সমাজকর্মী লিখছেন, আরও এক ধাপ এগিয়ে মমতা সে দিন বলেছিলেন, আজাদকে খুন করা হয়েছে। ক্ষমতায় আসার পরে আলোচনার রাস্তা খুলে দিলেও কিছু দিন পর থেকে মমতা বলতে থাকেন, তিনি মাওবাদীদের যথেষ্ট সময় দিয়েছেন, কিন্তু তাঁরা সাড়া দেননি। এ বার পুলিশি ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্রমে শান্তিপ্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। অগ্নিবেশ যদিও লেখেননি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তার আগে এই শান্তি আলোচনা চালানোর ব্যাপারে যথেষ্ট তৎপর ও আন্তরিক ছিলেন। শান্তিপ্রক্রিয়া চলার মধ্যেই ২০১১-র সেপ্টেম্বরে ঝাড়গ্রামে মাওবাদীদের হাতে ঝাড়খণ্ড জনমুক্তি মোর্চার রাজ্য সম্পাদক বাবু বসুর হত্যা সামগ্রিক পরিস্থিতি রীতিমতো উত্তপ্ত করে দেয়। ১৫ অক্টোবর লালগড়ের জনসভায় মমতা বলেন, “আপনারা (মাওবাদীরা) সুপারি কিলার। কোনও ‘বাদ’ (ইজম) নেই।”
এর পরে অবশ্য কিষেণজির মৃত্যু এই রাজ্যে শান্তি আলোচনার ভবিষ্যৎ আরও গভীর অনিশ্চয়তার মেঘে ঢেকে দিয়েছে!
এই গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনা হয়েছে রাষ্ট্র ও অন্য শক্তির হিংসা এবং শান্তি প্রক্রিয়ার রাজনীতি নিয়ে। লিখেছেন গৌতম নওলাখা, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য প্রমুখ। আছে লালগড় আন্দোলন নিয়ে একটি বিতর্কও। একটি দৈনিকে মাওবাদীদের উদ্দেশে সুজাত ভদ্রের খোলা চিঠির জবাবে কিষেণজি এবং অমিত ভট্টাচার্যের দু’টি চিঠি এই সংকলনে ঠাঁই পেয়েছে।
চতুর্থ অধ্যায়ে শাশ্বতী ঘোষ, কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জঙ্গলমহলে কাজ করা মানবাধিকার ও সমাজকর্মীদের নিবন্ধ নানা বিষয়ে আলোকপাত করেছে। সাংবাদিক বিশ্বজিৎ রায় সম্পাদিত এই গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যোজনা কমিশনের রিপোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের রায়, মাওবাদী শীর্ষ নেতা গণপতির পুরনো সাক্ষাৎকারও এখানে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক একটি বহুচর্চিত বিষয়ের উপরে ৫৪৮ পাতার এই সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। জান মিরডালের রেড স্টার ওভার ইন্ডিয়া-র পরে এই গ্রন্থ প্রকাশ নিঃসন্দেহে সেতু প্রকাশনীর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে পড়বে। |
|
|
|
|
|