এ বার দেখবে কে, বরুণের খুনে প্রশ্ন সুটিয়ার
বেতনের প্রায় পুরো টাকাটাই চলে যেত সমাজসেবায়। মাসের শেষে অনেক সময় হাতও পাততে হত আত্মীয়-বন্ধুদের কাছে।
তা সত্ত্বেও নিজের নীতি-আদর্শ থেকে সরে আসেননি বরুণ বিশ্বাস। গাইঘাটার সুটিয়ার বিশ্বাসপাড়ার যুবক বরুণের মৃত্যুতে যে কারণে নিজেদের ‘অভিভাবকহীন’ বলে মনে করছেন অনেকেই। মহিলারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। চোখের জল বাঁধ মানছে না তাঁদের। শুক্রবার সন্ধ্যায় বরুণবাবুর মৃত্যুতে যে শোকমিছিল হয়েছে এলাকায়, তাতে কয়েক হাজার মানুষ পা মিলিয়েছেন। এলাকায় দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যুবকটির প্রশংসায় বনগাঁর এসডিপিও জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়কেও বলতে হল, “ওঁর মৃত্যু গাইঘাটার পুলিশের কাছেও ক্ষতি। দোষীদের গ্রেফতার করাটা আমাদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ।”
শেষ শ্রদ্ধা বরুণকে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গোবরডাঙা স্টেশনে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন সুটিয়া গণধর্ষণ মামলার অন্যতম সাক্ষী বরুণ। রাত থেকেই তাঁর বাড়িতে আত্মীয়-প্রতিবেশীদের ভিড় উপচে পড়ছে। কিন্তু সদ্য পুত্রহারা পিতা জগদীশ, মা গীতাঞ্জলির তাতে কান্না থামার নয়। বরুণবাবুরা তিন ভাই, দুই বোন। ভাইদের মধ্যে ছোট বরুণ। ছোট থেকেই অকুতোভয়। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ না করে থাকতে পারতেন না বলে জানালেন অনেকেই। সেই সঙ্গে ছিল সমাজসেবার নেশা।
দাদা অসিতকুমারের কথায়, “মাইনের পুরো টাকাটাই খরচ করে ফেলত লোককে সাহায্য করে। অনেক সময় মাসের শেষে আমার কাছে কিছু টাকা চাইত।” বরুণবাবুর বন্ধু অমল মজুমদারও বলেন, “নিজের জন্য মাইনের টাকা রাখার ওর কোনও ইচ্ছেই ছিল না।”
কোথায় যেত সেই টাকা?
তার সাক্ষী সুটিয়ার অসংখ্য মানুষ। বোলদেঘাটার ফুলমালা মজুমদার বলেন, “আমার স্বামীর তিন বার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। প্রতিবারই খরচ-খরচা দিয়ে স্বামীকে সুস্থ করে তুলেছিলেন উনি। বরুণ না থাকলে আমার স্বামী বাঁচতই না।” প্রতিবেশী শিল্পী বিশ্বাস জানালেন, দিন কয়েক আগে এলাকার এক যুবক বিষ খেয়েছিলেন। সে খবর বরুণের কানে পৌঁছতেই গাড়ি ভাড়া করে ওই যুবককে হাবরা স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান বরুণ। পরে চিকিৎসা বেঁচে যায় ওই যুবক। রঞ্জিত চৌধুরী জানালেন, তাঁর ছেলেকে বরাবর বইপত্র কিনে সাহায্য করেছেন বরুণ। জয়ন্তী বণিক জানান, অভাবের সংসারে অনেক সময়ে খাওয়া না জোটার মতো দশা হয়। সে খবর শুনলেই নিজে এসে চাল-ডাল কিনে দিয়ে গিয়েছেন বরুণ। কখনও সখনও নগদ টাকাও হাতে দিয়েছেন। টাকার অভাবে কারও বিয়ে আটকে যাওয়ার দশা হয়েছে জানতে পারলেই সেখানে টাকা নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন বরুণবাবু। এ ছাড়া, রক্তদান ছিল আর এক নেশা। বরুণের এক সহপাঠী পার্থসারথি দে বলেন, “বন্ধু হিসাবে ও বিরল ধরনের মানুষ। যে কোনও সমস্যায় বরাবর ও-ই ছিল আমাদের সকলের মুশকিল আসান।”

নিহত বরুণের বাড়ির সামনে প্রতিবাদী মঞ্চের সদস্যদের অবস্থান।

পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ স্থানীয় মানুষের।
এলাকায় চোলাইয়ের ঠেকের বিরুদ্ধে অভিযান, পাচারের প্রতিবাদে সব সময় সামনের সারিতে থেকেই করেছেন বরুণ। প্রতিবেশী মহিলাদের অনেকেরই বক্তব্য, “সুটিয়ায় ধীরে ধীরে শান্তি ফিরেছিল। এ বার বরুণের মৃত্যুতে ফের আতঙ্কের পরিবেশ ফিরে আসবে। এক মহিলার কথায়, “কিছু দিন শান্তিতে বেঁচেছিলাম। এ বার কী হবে কে জানে!” সুটিয়া পঞ্চায়েতের প্রধান মিহির বিশ্বাস বলেন, “মানুষের জন্য সব সময় কাজ করতেন উনি। ভয়ডর বলে কিছু ছিল না।” দুষ্কৃতীরাও এলাকায় বরুণের দাপটে এলাকায় ঢুকতে ভয় পেত বলেও জানিয়েছেন বাসিন্দারা।
কিন্তু এক সময়ে এই ভয়ই জাঁকিয়ে বসেছিল সুটিয়াকে। ২০০০ সালের সেই সব দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনও আতঙ্কে কাঁটা হয়ে থাকেন বহু মানুষ। বরুণ বিশ্বাস, ননীগোপাল পোদ্দারদের মতো কয়েক জন মানুষই ‘প্রতিবাদী মঞ্চ’ গড়ে গণধর্ষণের ঘটনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। একে একে গ্রেফতার হয় সুশান্ত চৌধুরী, বীরেশ্বর ঢালিদের মতো কুখ্যাত দুষ্কৃতীরা। তাদের অনেকেই যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। সেই সব মামলায় সাক্ষী দেওয়াতেই অকালে প্রাণ হারালেন বরুণ, এমনটাই মনে করেন ননীগোপালবাবু। তিনি জানান, বহু বার বলার পরেও সুটিয়া থেকে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে আগ্রহ দেখায়নি পুলিশ। বছর বাহাত্তরের অতুলচন্দ্র বিশ্বাস জানালেন, যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামীদের ছাড়া পাওয়ার সময় এগিয়ে আসছে। সে জন্যই এলাকায় ফের প্রভাব বিস্তার করতে চায় তারা। বরুণের মতো জনপ্রিয় যুবককে মেরে ফেলার পরিকল্পনা সে জন্যই করেছে। এলাকায় ফের আতঙ্কের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে চায় দুষ্কৃতীরা।
সমাজসেবা এবং এলাকার মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও কেমন ছিলেন মিত্র ইন্সটিটিউশনের বাংলার শিক্ষক বরুণ?
বারাসত হাসপাতালে এ দিন এসেছিলেন তাঁর একাধিক সহকর্মী, ছাত্র, অভিভাবক। দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র দেবায়ন মুখোপাধ্যায় বলে, “ওঁকে কখনও রেগে যেতে দেখিনি। মারধর তো দূরের কথা। খুব দুষ্টুমি করলে বলতেন, বাঁদর। আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতেন।” বরুণবাবুর সহকর্মী সুশান্ত কর বলেন, “মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কুকর্মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পরাণ দিতে হল ওঁকে। এ বার ওঁর মৃত্যুর প্রতিবাদে আমরা পথে নামব।”

ছবি: শান্তনু হালদার ও সুদীপ ঘোষ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.