পত্রিকা: কী ব্যাপার? আপনাকে আর আগের মতো মিডিয়াতে দেখা যায় না। পার্টি আর পেজ থ্রি থেকেও আপনি উধাও। বঙ্গভূষণের মতো উপাধি পাওয়ার পরও বিক্রম ঘোষ এত লুকিয়ে আছেন কেন?
বিক্রম: না, না, বিক্রম ঘোষ একেবারেই লুকিয়ে নেই। ভীষণ ভাবে কলকাতায় আছি। আর অনেক অনেক বেশি বেশি কাজ করছি। (হাসি) আসলে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে আমি এখন নতুন একটা সৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। যখন এই ধরনের সৃজনশীল সময় আসে আমি কেমন জানি পুরোপুরি স্কিৎজোফ্রিনিক হয়ে যাই। পুরোপুরি স্প্লিট পার্সোনালিটি তখন আমার। এখন আমার এই রকম দশা শুরু হলে সব থেকে বেশি যার ভোগান্তি হয় সে আমার স্ত্রী জয়া (শীল ঘোষ)।
পত্রিকা: এইরকম স্কিৎজোফ্রিনিক দশার মধ্যে দিয়ে যখন যান, জয়া আপনাকে কী বলেন?
বিক্রম: আগে খুব অস্থির হয়ে পড়ত। এখন হাসে। আগে ভয়ও পেত খুব। কিন্তু এখন ও জানে যখন আমার সৃষ্টিশীল মনটা একেবারে তুঙ্গে চড়ে রয়েছে তখনই এমন হয়।
পত্রিকা: শেষ সাক্ষাৎকারের সময় আপনাকে দেখে ভীষণ অস্থির মনে হয়েছিল। এখন আপনাকে দেখে অনেকটা শান্ত মনে হচ্ছে।
বিক্রম: হ্যাঁ। তা হয়েছি বটে। এই বদলটা ঘটার ক্ষেত্রে অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে একটা বড় কারণ হল সাফল্য। সাফল্য মানুষকে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস দেয়, সাহস দেয়। আসলে একটা সময় ছিল যখন একটা যুদ্ধ চলত। যুদ্ধ চলত তবলা নিয়ে।
পত্রিকা: ব্যক্তিত্বের এই বদলটা ঘটল কী করে?
বিক্রম: দেখুন আমার শর্ত ছিল একটাই, তবলা শিল্পীরা যেন তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পান।
পত্রিকা: কী মনে হত? তবলা শিল্পীরা তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা পাচ্ছেন না?
বিক্রম: একেবারেই তাই। তবলা শিল্পীদের পাওনার ঘর ছিল শূন্য। তবে গত কয়েক বছরে পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক বদলেছে। কিন্তু একটু যদি মনে করেন পুরনো কথা, দেখবেন চিরকাল এমনটা ছিল না। রবিশঙ্কর-কিষেণ মহারাজের সময় এমনটা ঘটত না। ওঁরা যখন বাজাতেন মনে হত মঞ্চে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ম্যাচ হচ্ছে। শ্রোতারা উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করতেন শিল্পীদের কেরামতি আর দক্ষতার লড়াই দেখার জন্য। কিন্তু তার পর সময় যত এগোল ছবিটা বদলাতে লাগল। তবলা শিল্পীদের পুরোপুরি পেছনে ঠেলে দেওয়া হতে লাগল।
এটা খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমি কোনও দিনই এই পেছন দিকে থাকা শিল্পী হতে চাইনি। এ ভাবে কথা বলছি মানে যে আমি ‘বৈপ্লবিক’ হতে চাই, তা কিন্তু নয়। যদি কোনও কনসার্টে নেপথ্যের শিল্পী হয়ে থাকাটাই প্রয়োজনীয় হয় আমি খুশি মনে তাই করব। অন্যথায় নয়। |
পত্রিকা: এখন কি মনে হয় সেই প্রতিবাদী, বিদ্রোহী, জিততে পেরেছে যুদ্ধটা?
বিক্রম: হ্যাঁ, সেই বিদ্রোহী এখন আগের চেয়ে অনেক শান্তিতে। আজকাল আমি ফিউশনের চেয়ে অনেক বেশি ক্ল্যাসিকাল তবলা বাজাই। ক্ল্যাসিকাল আর ফিউশনের অনুপাত কষলে দাঁড়াবে ৭০:৩০। সারা জীবনে
যত বাজিয়েছি আমার তো মনে হয় এই মুহূর্তে তার
মধ্যে সেরা বাজাচ্ছি।
পত্রিকা: আজ অতীতের দিকে ফিরে তাকালে কি এটা মনে হয় যে আপনি চিক-ড্রামিং করার ভাবমূর্তিটাকে একটু বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলেন?
বিক্রম: কখনওই বাড়াবাড়ি কিছু করিনি। দেখুন ইমেজ ব্যাপারটা তো তৈরি করে মিডিয়া। অনেকটা সেই রকমই প্রচারমাধ্যম আমার ‘চিক ড্রামার’ ইমেজটা তৈরি করেছিল। যাঁরা সমালোচনা করেছিলেন তাঁদের বলতে চাই চিক ড্রামিংয়ের পর এ বার আমি আর একটা নতুন ধরনের সৃষ্টি করতে চলেছি। সেটা হল ‘বডি ড্রামিং’। সারা শরীর দিয়ে বাজনা বাজানো।
পত্রিকা: আপনার ভাবমূর্তি বা যশ যাঁরা খর্ব করেছেন তাঁরা তো এ কথা পড়ে আরও ক্ষুব্ধ হবেন, বলবেন আগে ‘চিক ড্রামিং’ ছিল, এ বার ‘বডি ড্রামিং’ বিক্রমের নতুন গিমিক।
বিক্রম: তাঁরা আমার প্রতি বহু কাল ধরেই ক্ষুব্ধ। তাঁরা চিরকালই বলেছেন বিক্রম গাল বাজায়। তাঁদের বক্তব্য, গাল বাজানো তো শাস্ত্রে নেই। শাস্ত্রে কি সব থাকতে হবে নাকি! আমার কথা হল ব্যাপারটা যদি এতই সোজা হয় আপনারা করে দেখান। অন্য কেউও তো এটা করতে পারত। কেউ কি ছেড়ে দিত নাকি? তারা করেনি কারণ তারা পারেনি।
পত্রিকা: যাঁরা আপনার কঠোর সমালোচনা করেছেন তাঁদের কথা উঠলেই যেন সেই আগের রাগী বিক্রম ফিরে আসেন।
বিক্রম: যাঁরা আমার অপপ্রচার করেছেন তাঁদের প্রতি আমার জবাব এইটাই যে বিক্রম ঘোষ শুধু ‘চিক ড্রামিং’ই করে না। যদি তাই করতাম তা হলে তো আমি একজন আফ্রিকান মিউজিসিয়ান হতাম। তাদের চেয়ে তো আমি আলাদা। সমালোচকেরা এটাই বুঝতে চান না যে তবলা আর মৃদঙ্গম বাজানোর সব পদ্ধতি, ব্যাকরণ আমি গাল বাজিয়ে করতে পারি।
পত্রিকা: বিশুদ্ধ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থেকে সরে এলেন। এর জন্য আপনার বাবা পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষ কখনও রাগ করেননি?
বিক্রম: না। কোনও দিনই নয়। ইনফ্যাক্ট বাবা হলেন রকস্টার। উনি আমাকে বাজনায় উদ্ভাবনী শক্তি ব্যবহার করতে বলেছিলেন। সোজা কথায় যেটা ইমপ্রোভাইজেশন। বাবা না অনুপ্রেরণা দিলে আমি ক্ল্যাসিকাল তবলার বাইরে গিয়ে কোনও কিছু করতেই পারতাম না হয়তো।
পত্রিকা: তার মানে বাড়িতে কারও ভ্রুকুটি আপনাকে দেখতে হয়নি?
বিক্রম: কোনও দিন না। তা না হলে আমি বিক্রম ঘোষ হতাম না। শো-এ দেখবেন প্রচুর ইমপ্রোভাইজ করি আমি। ধরা যাক আমার সঙ্গে আরও দু’জন বাজাচ্ছে। তেহাইয়ের মাঝে ঘটম, মৃদঙ্গম, ও তবলা শূন্যে তুলে, আবার ধরে নিয়ে তালে ফিরি আমরা। তোলা আর ফেরার মধ্যেই পড়ে যায় তাল, হয়ে যায় ছন্দ। বাবা এগুলো পছন্দ করেন।
পত্রিকা: বঙ্গভূষণের প্রসঙ্গে ফিরি। এটা নিশ্চয়ই আপনার জীবনের একটা গর্বের মুহূর্ত?
বিক্রম: হ্যাঁ, গর্বের মুহূর্ত তো বটেই। কারণটাও খোলসা করে বলি। আমি তো অনেক দিন ধরে ইউরোপ আমেরিকায় অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছি। সেখানকার লোকজন আমাকে অনেক সময় সেখানেই সেট্ল হতে বলেছেন। এমনকী রবিজি আমাকে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগো-তে থেকে যেতে বলেছিলেন। আমি সকলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ আমি কলকাতায় থাকতে চেয়েছিলাম। কলকাতায় থেকে কোনও কিছু সৃষ্টি করার যে অনুপ্রেরণা পাই, সেটা অতুলনীয়। (হাসি) সেই কারণেই দিনের শেষে আমি একজন সেন্টিমেন্টাল বাঙালি ছাড়া কিছু নই। বঙ্গভূষণ পুরস্কার আমাকে এ কথা বুঝিয়ে দিয়েছে কলকাতায় থাকার সিদ্ধান্তটা স্বীকৃতি পেল।
পত্রিকা: মুম্বইতে আপনি সোনু নিগমের সঙ্গে সঙ্গীত পরিচালনাও করছেন। তা কেমন চলছে কাজ?
বিক্রম: দেখুন আমি আর সোনু মিলে এমন কিছু সুর আবিষ্কার করেছি যা সত্যিই এক্সাইটিং। আমাদের সুর দেওয়া প্রথম ছবি হবে ‘জল’। তার পরের ছবি ‘সুপার সে উপর’। এ ছাড়াও আরও অনেক অফার আছে।
পত্রিকা: তবে এটা কি আপনি মানবেন যে সব প্রজেক্টের কাজ করছেন তার কোনওটাই বড় ব্যানারের কিছু নয়। সোনু আর বিক্রম কি পারবে শান্তনু মৈত্র বা শংকর-এহেসান-লয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে?
বিক্রম: আমাদের কারও সঙ্গে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। আমরা শুধু ভাল গান তৈরি করতে চাই। তবে বিগ ব্যানারের ছবির প্রস্তাবও আসছে। আমরা করবও। আমাদের দ্বিতীয় ছবি ‘সুপার সে উপর’ বিগ ব্যানারের ছবি। প্রযোজক রিলায়্যান্স। |
পত্রিকা: আপনাদের মিউজিক টিমের নাম কী হবে?
বিক্রম: মিউজিক বাই সোনু নিগম-বিক্রম ঘোষ....এই ভাবে বলা হবে। ইন ফ্যাক্ট আমাদের নতুন টিম গড়া নিয়ে বিখ্যাত পত্রিকা ‘হলিউড রিপোর্টার’-এ আধখানা পাতা জোড়া লেখাও বেরিয়েছে সম্প্রতি।
পত্রিকা: যদি তাই হয় বলিউডে আপনারা দু’জনে এত লো-প্রোফাইলে থাকেন কেন?
বিক্রম: শ্রোতারা আগে আমাদের গান শুনুন, তার পরে তো কথা। সেই কারণেই লো-প্রোফাইলে থাকি।
পত্রিকা: আপনি তো বাংলা ছবিতেও সঙ্গীত পরিচালনা করছেন। এটা কি মনে হয় সুরারোপে অনুপম রায় বা নীল দত্ত আপনার চেয়ে এগিয়ে...
বিক্রম: ব্যাপারটাকে আমি ঠিক এ ভাবে দেখি না। এদের সঙ্গে কোনও ভাবেই আমার তুলনা হয় না। আমি প্রধানত সঙ্গীতশিল্পী। পরে সঙ্গীত পরিচালক। আমার একটা নিজস্ব ‘সাউন্ড’ আছে। যাঁরা সেই ‘সাউন্ড’ চান, তাঁরা আমার কাছে আসবেন। পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে যেমন লক্ষ্ণীকান্ত-পেয়ারেলালের কোনও তুলনা হয় না, অনেকটা সে রকমই। নিজের সঙ্গে রবিজির তুলনা করছি না। বোঝাতে চাইছি আমি প্রধানত সঙ্গীতশিল্পী আর যাঁদের কথা বলা হচ্ছে তাঁরা সঙ্গীত পরিচালক বা গীতিকার। ‘নোবেল চোর’ ছবিতে আমার সুর যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে আমার ভাল লেগেছে ‘উড়ো চিঠি’র ‘শহর ব্যালাড’ গান আর ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর ‘গভীরে যাও’।
পত্রিকা: ‘অটোগ্রাফ’ নয়?
বিক্রম: ‘অটোগ্রাফ’ ভাল তবে তার চেয়ে ওপরের গানগুলো বেশি ভাল লেগেছে।
পত্রিকা: ‘হঠাৎ নীরার জন্য’র পর আপনাকে আর বড় পর্দায় দেখা গেল না তো?
বিক্রম: একটা কথা খুব সততার সঙ্গে বলতে চাই। প্রত্যেক মাসেই আমার কাছে পাঁচ ছ’টা করে ছবির অফার আসে। কিন্তু সে কাজগুলো আমার কাছে খুব উত্তেজক মনে হয় না। তা না হলে ছবিতে অভিনয় করতে আমার কোনও আপত্তি নেই।
পত্রিকা: সম্প্রতি অনেক দিনের বন্ধু তন্ময় বসুর সঙ্গেও তো ঝামেলা মিটিয়ে নিয়েছেন।
বিক্রম: হ্যাঁ। আমাদের আর কোনও বিরোধ নেই। এটা আমরা করেছি কারণ প্রচুর লোক আমাদের ঝগড়া নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলছিল, এবং পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছিল। সেই থেকেই আমরা উপলব্ধি করি এই ভাবে ঝগড়া করার কোনও মানে হয় না। এখন আমরা আবার পুরনো দিনগুলোর মতো বন্ধু।
পত্রিকা: আপনি কি আবার তন্ময়ের সঙ্গে মিউজিক কম্পোজ করতে চান?
বিক্রম: এখনও পর্যন্ত আমাদের সেরকম কোনও পরিকল্পনা নেই। আপাতত আমরা বন্ধুত্বটা উপভোগ করতে চাই। গানবাজনা অপেক্ষা করতে পারে।
পত্রিকা: বিক্রম ঘোষ কিন্তু মানুষ হিসেবেও খুব বর্ণময়.....
বিক্রম: কেন, কেন, এসব আবার কেন....(হেসে)
পত্রিকা: আপনার এক সতীর্থ সঙ্গীতশিল্পী বলেছিলেন, বিক্রম যখন অবিবাহিত ছিল সারা পৃথিবীর যে যে শহরে ও যেত সব জায়গাতেই এক জন করে গার্লফ্রেন্ড থাকত।
বিক্রম: মনে হচ্ছে যে এ কথা বলেছে সে খুব দয়ালু। আর হিংসুটেও। (জোরে হাসি)
পত্রিকা: তা সেই সব বান্ধবী এখন কোথায়?
বিক্রম: আমি কোনও যোগাযোগ রাখিনি ইয়ার। এখন আমি সুখী বিবাহিত। আরে বাবা বয়স তো হল। আর কত?
পত্রিকা: শেষ প্রশ্ন। তা হলে তবলা বাজানো ছেড়ে বিক্রম ঘোষ পায়রা পুষবেন কার হাসি দেখে?
বিক্রম: শুধু আমার স্ত্রী জয়ার হাসি দেখলে (হাসি)। বুঝলেন! |