ব্যাগ গুছিয়ে...
রেল ছুটেছে গাংরেল
রায়গড়া, বিলাসপুর, দুর্গ, জগদলপুর, ধমতেরি ধমতেরি...। বাসের গায়ে হেলান দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ছেলেটা চেঁচাচ্ছিল। ঠিক দিশা ও-ই দিতে পারবে মনে হয়। আমার প্রশ্নে ছেলেটা পাশের লোকটিকে জিজ্ঞাসা করে বলল, ‘‘ধমতেরিতে নেমে যান, সেখান থেকে অটো বা সুমোয় গাংরেল।’ বুঝলাম স্পটটা এখনও বেশ আনকোরা। ছত্তীসগঢ়ের হরেক বৈচিত্রেও গাংরেল সত্যি একটু আলাদা।
রায়পুর স্টেশন থেকে ‘ধমতেরি’ ৭৮ কিলোমিটার। ছত্তীসগঢ়ের এক সাদামাঠা জেলা শহর। রায়পুর থেকে ন্যারো গেজের ট্রেনও চলে এ পথে। এন এইচ ৪৩ ছেড়ে বাকি ১৪ কিমি-র আদিগন্ত ধানখেত। শাল-সেগুনের অহঙ্কার ডিঙিয়ে আদিবাসীদের ডেরার ভিতরে। এ বার একটা ইউ টার্ন দিয়ে ছোট্ট ‘ডুংরি’ বা টিলার উপর গাড়ি ডেডস্টপ।
সামনে আকাশছোঁয়া অনন্ত জল আর সবুজে মোড়া প্রকৃতির মাঝে ছত্তীসগঢ় ট্যুরিজমের ট্যুরিস্ট কটেজ। সামনের বাহারি বাগান আর সবুজ লনটার পাশেই মহানদীর জলে তখন হাওয়ায় ঢেউ তুলেছে দেদার। সূর্যের আলোয় তাদের মুকুটে রুপোলি ঝিলিমিলি। এত জঙ্গল জলপিপি আর পানকৌড়ি। কয়েকটার ঠোঁটে আবার টাটকা শিকার। গ্রে-হেরন ভেসে চলেছে ভাসমান কচুরিপানার পানসিতে। চোখের পলক পড়ে না, ক্যামেরার শাটার পড়তে থাকে অনবরত। রায়পুরের সিহওয়া পাহাড়ের কুণ্ড (জলাধার) থেকে সৃষ্ট মহানদীকে বেঁধে ফেলা হয়েছে এখানে। ড্যামের বিপুল জলরাশি থেকে সেচ আর বিদ্যুতে বিস্তীর্ণ অঞ্চল সবুজে উজ্জ্বল।
১৮০০ মিটার লম্বা ৩৩ মিটার উঁচু বাঁধ পেরিয়ে ও পারে এক বার গেলেই অপার আনন্দ। দু’কিলোমিটার ভ্রমণে নো আউটসাইড ভেহিক্যালস, শুধু সেচ বিভাগের বিশেষ বাসে যেতে-আসতে পাঁচ টাকা। প্রকৃতির নীচে রিয়েল জয়-রাইড। মহানদীর জলে দূরের পাহাড়ের ছায়া, ডিঙিতে ভেসে চলেছে মাছমারার দল। এদের হাতে আট-দশ কিলো কাতলা, চিতল শিকার নাকি হামেশা ঘটে। এই নদীর খাঁটি স্বদেশি সরপুঁটির স্বাদ নাকি...ধুস্, এ যাত্রায় যখন জুটলই না তখন শুনে কী হবে। গোন্দ, ধীমার, নিশাদ, রাউত প্রভৃতি মিশ্র আদিবাসীদের নীল-সাদা কুটিরের পাশে বিলেতবাসী বোগেনভেলিয়া, স্থানীয় গাঁদার রঙিন ককটেল।
দেওয়ালি তো বটেই, এ ছাড়াও নানা পরবে রং-বেরঙের আলপনায় সেজে ওঠে এদের উঠোন। রুপোর মোটা অলঙ্কারে কৃষ্ণকলিরা হয়ে ওঠে রমণীয়। পুরুষেরা সুঠাম, উদার। আসলে এখানকার প্রকৃতিই উদার, নির্বিষ। আদিবাসী অধ্যুষিত ছত্তীসগঢ়ের বহু পুরনো একাংশ বাস করছেন এখানে পুরুষানুক্রমে। দণ্ডকারণ্যের আদিম আদিবাসীদের বনদেবীর মন্দির আছে এখানে। যেতেই হবে, তবে একটা বিরতির পরে। গলাটা বেশ শুকিয়ে গিয়েছিল। লনের নরম ঘাসের কার্পেটে বসে চা আর পকোড়ার সেবায় আদিবাসী কর্মচারীরা মন জিতে নিল আবার।
ট্যুরিস্ট হাউসের পাশ দিয়ে একটা পিচ ঢালা উঁচু-নিচু পথ এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে দু’পাশে বনের ভিতর দিয়ে। মাইলখানেক পথের মাঝে কবরখানাকে বাঁয়ে রেখে এক বিশাল পিপুলগাছের নীচে সাদা মার্বেলের চত্বর। লাল চাঁদোয়ার নীচে হাতি, ঘোড়া, গাধা, ষাঁড়, হনুমানের মূর্তি। সবাই পুজো পাচ্ছেন এখানে। লাল-হলুদ চেলি আর নারকোলের অতি সামান্য আয়োজনে এদের কুলদেবতা অতি তুষ্ট। মন্দিরের ঠিক পিছনে নদীর ঘাটে জলের রং হঠাৎ পাল্টে যাচ্ছে। এ বার সূর্য যাবে পাটে। মধ্যাহ্নের সাদা ঝিলিমিলি এ বারে ভীষণ রঙিন। গোলাপি আবির ছড়িয়ে সূর্য ডুবতে থাকে মহানদীর বুকে।
এ দিক থেকে পিচ ঢালা বনপথ দিয়ে আর একটু ট্রেক করলেই ছত্তীসগঢ় ট্যুরিজমের আর এক উপহার ‘অঙ্গার ইকো অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প’। ডানপিটে ট্যুরিস্টদের জন্য দেদার প্রাকৃতিক খোরাক। নদীর ছলাৎ শব্দ ঘেঁষে নেমে যায় দড়ির দোলনা, প্যাডেল বোটের রোমাঞ্চ আর তাঁবুতে থাকা। বনফায়ারটা করলেই হল আর কী। মায়াময় গোধূলি পথ ছাড়তেই লোরেং পোকা (ঝিঁঝিঁ)-দের সন্ধ্যার আরতিতে অন্ধকারের দরজা খুলে যায়। কুয়াশা-জড়ানো পথে তখন অন্য রোমাঞ্চ। গাছের ওপর চাপ চাপ জোনাক আলো পথ দেখায়। রাতচরা পাখির জ্বলন্ত চোখ আর হুতোমের হুঙ্কারকে সঙ্গে নিয়ে কটেজে ফিরে আসাও এক হঠাৎ অ্যাডভেঞ্চার। দূরে ব্যারেজের উপর আলোর মেলা। এই জলজ প্রকৃতির মধ্যে বিলাসী ডাইনিং-এ রুটি, মুরগির ঝোল...। ইস! কেন যে মাত্র এক দিনের বুকিং নিলাম।

কী ভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে ট্রেনে রায়পুর। সেখান থেকে গাড়িতে সরাসরি গাংরেল।
অথবা রায়পুর থেকে বাসে ধমতেরিতে নেমে অটো বা বাসে গাংরেল।
কখন যাবেন
সারা বছরই যাওয়া যায়। তবে বর্ষা ও শীত আদর্শ।
কোথায় থাকবেন

থাকার একমাত্র জায়গা ছত্তীসগঢ় ট্যুরিজমের বাংলো।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.